দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলের কর্পোরেট ও আইটি হাবগুলোয় হঠাৎ করেই এক তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নয়ডা এবং গুরুগ্রামের মতো আধুনিক শহরগুলোর আবাসিক এলাকায় রাঁধুনি ও গৃহপরিচারিকার ঘাটতি চরমে পৌঁছেছে। এর কারণ হলো, বেআইনি বাংলাদেশি সন্দেহে পুলিশের ধরপাকড় এবং আসন্ন ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ (SIR) প্রক্রিয়ার আশঙ্কায় বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা তড়িঘড়ি করে শহর ছেড়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাচ্ছেন। এর ফলে এখানকার শত শত পরিবার মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে।
পুলিশি ধরপাকড় এবং ভয়:
এই শ্রমিকদের মধ্যে অন্যতম নুরজাহান, যিনি নয়ডার গৌর সিটির একাধিক বাড়িতে কাজ করেন। তার পরিবারও তাকে দ্রুত ফিরে আসার জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছে। তিনি ইন্ডিয়া টুডে-কে জানিয়েছেন, তার বস্তি থেকে বহু বাংলাভাষী শ্রমিক ইতিমধ্যেই চলে গেছেন। পুলিশি অভিযানের ভয় তাদের মধ্যে এতটাই বেশি যে, আধার কার্ডের মতো বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও তারা ঝুঁকি নিতে রাজি নন।
গুরুগ্রামে হাসান শেখ নামে এক পরিযায়ী শ্রমিককে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে ‘হোল্ডিং সেন্টারে’ আটকে রেখে মারধর করে বলে অভিযোগ। সেখান থেকে পালিয়ে তিনি কোনোমতে প্রাণ বাঁচান। একই ধরনের অভিযোগ কসম মিঞারও, যিনি পরিচয় যাচাই করার জন্য পুলিশ সর্বসমক্ষে তাকে উলঙ্গ করেছিল বলে দাবি করেন। এই ধরনের ঘটনাগুলি পরিযায়ী শ্রমিকদের মনে গভীর আতঙ্ক তৈরি করেছে।
মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন:
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তাদের রাজ্যে ফিরে আসার অনুরোধ করে বলেছেন, “মুম্বই, উত্তরপ্রদেশ কিংবা রাজস্থানে থাকার কোনো দরকার নেই… আমরা একটা রুটি খেলে আশ্বস্ত করছি আপনারাও একটি রুটি খেতে পারবেন।” তিনি শ্রমিকদের জন্য পুলিশের হেল্পলাইন নম্বরও দিয়েছেন এবং রাজ্যে ফিরে আসার জন্য ট্রেন ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রায় ২,৫০০ বাংলাভাষী অভিবাসী শ্রমিক রাজ্যে ফিরে এসেছেন।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব:
নয়ডা ও গুরুগ্রামের মতো শহরগুলো মূলত পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল। রাস্তা পরিষ্কার কর্মী, গাড়ি ধোয়ার কর্মী থেকে শুরু করে গৃহপরিচারক—সবাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকদের এই হঠাৎ শহর ত্যাগ শুধু দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকেই নাড়িয়ে দেয়নি, বরং মুক্তচিন্তার ভাবমূর্তিতেও আঘাত করেছে।
নুরজাহানের মতো বহু পরিচারিকা মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা রোজগার করেন। এই রোজগার ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ানো। গ্রেটার নয়ডার গৌর সিটির আশপাশের বস্তিগুলোতে যে শত শত শ্রমিক বসবাস করতেন, তাদের অনেক ঘর এখন তালাবদ্ধ। তারা তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার স্বপ্ন ছেড়ে গ্রামের দিকে ফিরে গেছেন।
তবে সবার ক্ষেত্রেই চিত্রটা এক নয়। নয়ডায় রাঁধুনির কাজ করা অর্পূজা, যার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত, তিনি কোচবিহারে ফিরে ডোমিসাইল সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার আশা, বৈধ নথি পাওয়ার পর তিনি আবার কাজে ফিরতে পারবেন। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিকের কাছেই এই ধরনের আইনি প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল।