প্লাটিলেট, মানবদেহের ক্ষুদ্র সৈনিক ও তার বিপদ ঘণ্টা! ডেঙ্গু আতঙ্ক নাকি অন্য কারণ?

মানবদেহের রক্তপ্রবাহে থাকা তিন ধরনের রক্তকণিকার মধ্যে সবচেয়ে ছোট কিন্তু অত্যন্ত জরুরি একটি উপাদান হলো প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা। শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ দ্রুত বন্ধ করার মূল কাজটি এই প্লাটিলেটই করে থাকে। অনেকটা ক্ষুদ্র সৈনিকের মতো, যারা রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেহকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কণিকাটির সংখ্যা কমে গেলেই শুরু হয় বিপদ।

কেন কমে প্লাটিলেট? মূল কারণ ও নেপথ্যের রহস্য:

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাটিলেট কমে যাওয়ার দুটি প্রধান কারণ হলো: হয় প্লাটিলেট দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথবা অস্থিমজ্জায় পর্যাপ্ত পরিমাণে প্লাটিলেট তৈরি হচ্ছে না। রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, তখন এই অবস্থাকে ‘থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া’ বলা হয়।

তবে এর পেছনের কারণ আরও বিচিত্র হতে পারে:

রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া): রক্তে হিমোগ্লোবিন ও লোহিত রক্তকণিকা কমে যাওয়া।

সংক্রমণ: বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ (যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া) প্লাটিলেট কমাতে পারে।

মারাত্মক রোগ: লিউকেমিয়া (রক্তের ক্যান্সার), তীব্র মাত্রার ক্যান্সার, অথবা পিত্তথলির বিভিন্ন মারাত্মক রোগের কারণেও প্লাটিলেট কমে যেতে পারে।

চিকিৎসা পদ্ধতি: কেমোথেরাপি বা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

পুষ্টির অভাব: ভিটামিন-বি ১২ এর তীব্র অভাব।

জীবনযাত্রা: অতিরিক্ত মদ্যপান।

অন্যান্য: রক্তে ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহ, এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাজনিত (অটোইমিউন) রোগবালাইয়ের কারণেও প্লাটিলেট ভেঙে যেতে পারে।

প্লাটিলেট কমলে কী ঘটে? শরীরের সতর্কবার্তা:

একজন সুস্থ মানুষের প্লাটিলেটের স্বাভাবিক মাত্রা হলো প্রতি মাইক্রোলিটারে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। এই সংখ্যা যখন ২০ হাজারের নিচে নেমে আসে, তখন শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের (ইন্টারনাল ব্লিডিং) সম্ভাবনা থাকে। আর যদি তা ৫ হাজারের নিচে নেমে যায়, তখন মস্তিষ্ক, কিডনি বা হৃদপিণ্ডের মতো অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গে রক্তক্ষরণের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়। তবে মনে রাখা জরুরি, মেশিনে প্লাটিলেট গণনায় অনেক সময় ভুল হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট অনেক সময় দলা পেকে থাকে, যা মেশিন একসঙ্গে একটি কণা হিসেবে গণনা করে।

বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া সবসময়ই ‘মেডিকেল ইমারজেন্সি’ নয়। অর্থাৎ, প্লাটিলেট কমলেই যে রোগী হঠাৎ রক্তক্ষরণে মারা যাবেন, এমনটা নয়। প্লাটিলেট কমলে সাধারণত ত্বকের নিচে ছোট ছোট কৈশিক রক্তনালী থেকে রক্তক্ষরণ হয়, যা ত্বকে বেগুনি রঙের চিহ্ন বা পিনপয়েন্টের মতো ফুসকুড়ি আকারে দেখা যায়।

প্লাটিলেট কমে যাওয়ার লক্ষণসমূহ:

ত্বকে বেগুনি রঙের দাগ বা চিহ্ন।

শরীরের যেকোনো স্থান থেকে সূক্ষ্ম রক্তপাত, যা পিনপয়েন্টের আকারে দেখা যায়।

শরীরের কোথাও কাটলে অনেকক্ষণ ধরে রক্তপাত।

মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত।

প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্তপাত।

মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া।

তীব্র ক্লান্তি।

ডেঙ্গু ও প্লাটিলেট: প্রচলিত ভুল ধারণা ও বাস্তবতা:

প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কথা উঠলেই ডেঙ্গুর প্রসঙ্গ চলে আসে। তবে মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু ছাড়াও আরও অনেক কারণে প্লাটিলেট কমতে পারে। অনেক রোগীই প্লাটিলেট কাউন্ট ৫০ হাজারের নিচে নামলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান, প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া দিয়ে ডেঙ্গুর তীব্রতা মাপা হয় না। প্লাটিলেট দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন, এমন ধারণাও ঠিক নয়।

সাধারণত, যখন রক্তক্ষরণের সুস্পষ্ট চিহ্ন দেখা যায় এবং প্লাটিলেট কাউন্ট ২০ হাজারের নিচে নামে, অথবা রক্তক্ষরণ না থাকলেও প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নেমে যায়, তখনই রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে গিয়ে রোগী মারা যান না, বরং মারা যান ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’-এর কারণে। ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর গায়ে থাকা ছোট ছোট ছিদ্রগুলো বড় হয়ে যায়। তখন রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস রক্তনালী থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। এর ফলে রক্তচাপ দ্রুত কমতে থাকে এবং রক্ত ঘন হয়ে যায় (পিসিভি বা প্যাকড সেল ভলিউম বাড়তে থাকে)। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল (ফ্লুইড) দিতে হবে, যা মুখে অথবা শিরায় দেওয়া যেতে পারে।

ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কাউন্টের দিকে ঘন ঘন নজর না দিয়ে বরং রোগীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখা বেশি জরুরি: রক্তচাপ স্থিতিশীল আছে কি-না, রোগী জলশূন্যতায় ভুগছে কি-না, এবং রক্তের পিসিভি বা হেমাটোক্রিট কেমন আছে। এই বিষয়গুলো ঠিক থাকলে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তরল প্রদান করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলেই রোগীকে সুস্থ রাখা সম্ভব।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy