সম্পর্ক যেন এক সযত্নে গড়া ঘরবাড়ি, যেখানে ভালোবাসা আর বিশ্বাসে গাঁথা প্রতিটি ইট। কিন্তু কখন যে তাতে ‘নোনা ধরে’, কখন যে অজানতে পলেস্তারা খসে পড়তে শুরু করে, তা বোঝা কঠিন। যখন এই ফাটল গভীর হয়, তখন শত মেরামতির চেষ্টা করেও ভাঙন ঠেকানো যায় না, পরিণতি হয় বিচ্ছেদ আর সীমাহীন যন্ত্রণা। কিন্তু এমন কোনো উপায় কি নেই, যা দেখে আমরা আগেভাগেই পরিস্থিতির আঁচ করতে পারি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাসের দিকে ভালো করে নজর রাখলেই সম্পর্কের এই নীরব বিপদগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব।
বিশেষ করে বর্তমান ব্যস্ত কর্পোরেট জীবনে পরকীয়ার ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। পুলিশের দ্বারস্থ হওয়া গেলেও তাতে কাচের গায়ে পড়া ফাটলের দাগ মোছা যায় না। তাই সম্পর্ক বাঁচাতে হলে আগে তার ভাঙনের লক্ষণগুলি চিনে রাখা জরুরি। এখানে পরকীয়ায় লিপ্ত সঙ্গীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
১. আকস্মিক ব্যবহারে পরিবর্তন: যখন চেনা মানুষটি অচেনা হন
আপনার খুব চেনা কাছের মানুষটির ব্যবহারে যদি আকস্মিক এবং অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন আসে, তবে তা সন্দেহের কারণ হতে পারে। যিনি পারিবারিক ব্যাপারে বরাবরই অত্যন্ত জড়িত থাকতেন, তিনি যদি হঠাৎ উদাসীন হয়ে পড়েন, অথবা যিনি এতদিন পরিবারের প্রতি নির্লিপ্ত ছিলেন, তিনি যদি হঠাৎ অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন—উভয় ক্ষেত্রেই সন্দেহের অবকাশ থাকে। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণই এই ব্যবহারিক পরিবর্তনগুলো গোচরে আনতে পারে।
২. সঙ্গীর সঙ্গে কম সময় কাটানো: দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা
হতাশা, একাকীত্ব, একঘেয়েমি বা যৌনতায় অপূর্ণতাবোধ থেকেই অনেক সময় মানুষ সম্পর্কে থাকাকালীনও নতুন সম্পর্কের দিকে ঝোঁকেন। তাই যদি দেখা যায় আপনার সঙ্গী আপনার সঙ্গে সময় কাটানো কমিয়ে দিয়েছেন বা এড়িয়ে চলছেন, তবে বুঝতে হবে এই সমস্যাগুলির কোনো একটি তাকে গ্রাস করেছে এবং এটি নতুন সম্পর্কের এক নীরব ইঙ্গিত হতে পারে।
৩. গোপনীয়তা: লুকানো ফোনের আড়ালে
প্রত্যাশিতভাবেই কেউ তার পরকীয়ার বিষয়টি পরিবারের সামনে আনতে চান না। তাই যদি আপনার সঙ্গী ছোটখাটো বা সাধারণ বিষয়ও আপনার থেকে লুকাতে শুরু করেন, তবে তার পরকীয়ায় লিপ্ত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অপরাধবোধ অবচেতন মনে গোপনীয়তা বা যেকোনো কিছু লুকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি করে।
৪. সন্দেহজনক ফোন ব্যবহার: সুর পাল্টায় কথার সুরে
আপনার সঙ্গী ফোনে কী ধরনের কথা বলেন বা কোন স্বরে কথা বলেন, তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। কিন্তু হঠাৎ করে যদি তার ফোনে কথা বলার ধরণ বা স্বরে পরিবর্তন আসে, তবে সন্দেহ জাগা অমূলক নয়। বিশেষ করে, যদি বিশেষ কোনো ফোন কলের ক্ষেত্রে সঙ্গী নিচু স্বরে কথা বলেন, বা এমনভাবে কথা বলেন যাতে অন্য কেউ তা জানতে না পারেন, তবে পরকীয়ায় জড়িত থাকার সম্ভাবনা জোরালো হয়।
৫. রাত করে ফেরা বা ঘনঘন ট্রিপ: অজুহাতের নতুন জাল
কোনো পূর্ব পরিকল্পনা বা জানানো ছাড়াই যদি সঙ্গী বারবার অফিসের কাজের কথা বলে রাত করে ফেরেন বা ঘনঘন অফিসের ট্রিপে যান এবং এই প্রবণতা যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তবে সন্দেহ হতেই পারে। সাধারণত কাজের সময় অনুযায়ী বাড়ি ফেরার সময়ও নির্ধারিত থাকে। দু-একদিন ব্যতিক্রম হতেই পারে, কিন্তু ক্রমাগত যদি এই নিয়ম ভাঙতে থাকে, তবে পরকীয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
৬. অকারণ ব্যাখ্যা দেওয়া: অপরাধবোধের ছায়া
আপনি কিছু না জিজ্ঞেস করতেই যদি সঙ্গীর আচরণে অকারণ ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, তবে তা সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করে। আসলে অপরাধবোধ থেকে বা তিনি যে কোনো খারাপ কাজ করছেন না, তা প্রমাণ করতেই পরকীয়ায় লিপ্ত ব্যক্তিরা এমন আচরণ করে থাকেন। তাই এই বিষয়ে আগেই সতর্ক থাকা উচিত।
৭. নিজের প্রতি বিশেষ নজর: হঠাৎ করে বদলে যাওয়া রুচি
নিজের খেয়াল রাখা ভালো, কিন্তু প্রতিটি মানুষ কতটা নিজের খেয়াল রাখেন তা তার কাছের মানুষ জানেন। এতে আচমকা অস্বাভাবিক পরিবর্তন এলে চিন্তার বিষয় আছে। যদি দেখা যায় এতদিন একজন যেভাবে পোশাক পরতেন, যা পছন্দ করতেন, তাতে দ্রুত বদল আসছে বা তিনি নিজের ফিটনেস নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে উঠছেন, তাহলে বোঝা যায় তার মধ্যে বড় পরিবর্তন এসেছে। তিনি অন্য কারও পছন্দ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন, এ অনুমান সহজেই করা যায়।
৮. বিরক্তি-খিটখিটে মেজাজ: যখন সম্পর্কের রেশ কাটছে
সংসারের দৈনন্দিনতায় আক্রান্ত হয়ে মেজাজ খারাপ কারো হতেই পারে। এমন সমস্যা প্রতিটি সম্পর্কে দেখা যায় এবং সঙ্গীরা তা নিজেদের মতো করে মিটিয়েও নেন। কিন্তু এর অন্যথা হলে ভাবনার অবকাশ আছে। যদি সঙ্গী আপনার উপর ক্রমাগত খিটখিটে ব্যবহার করেন, অকারণে মেজাজ হারান বা আপনার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি হয়তো অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন এবং আপনার প্রতি তার আগ্রহ কমে গেছে।
মূলত, সঙ্গীর ব্যবহারিক পরিবর্তনটাই এক্ষেত্রে মুখ্য। আচার-আচরণ, রুচি, কথা বলার ধরণ, দৈনন্দিন অভ্যাস এবং এমনকি যৌনতায় যদি স্বাভাবিকের থেকে বেশি ও দ্রুত হারে পরিবর্তন আসে, তবে পরকীয়ায় লিপ্ত থাকার সম্ভাবনা জোরদার হয়। প্রতিটি সম্পর্কে সঙ্গী একে অপরকে যে মাত্রায় চেনেন, সেভাবে অন্য কেউ চেনেন না। আর তাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগতভাবেই একজন বুঝতে পারেন, তার সঙ্গী কতটা তার আছেন আর কতটা নেই। এই লক্ষণগুলো চিনে সময় মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে হয়তো অনেক সম্পর্কই ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।