এই সময়ে শিশুদের জ্বর-জারি নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। জ্বর তিন দিনেও না সারলে তা চিন্তার কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যদি সেটি টাইফয়েড বা প্যারাটাইফয়েড হয়। কারণ, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে এই রোগ প্রাণঘাতীও হতে পারে। চলুন, জেনে নিই টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে।
জ্বরের ধরন ও লক্ষণ
টাইফয়েড জ্বরের তীব্রতা কম থেকে মাঝারি বা উচ্চমাত্রার হতে পারে এবং তা ক্রমাগত বাড়তে পারে। উচ্চমাত্রার জ্বরে শিশুরা সাধারণত দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে বমি, পাতলা পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। কিছু শিশুর কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্টের লক্ষণও থাকতে পারে। জিহ্বা সাদা প্রলেপযুক্ত হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে, ফর্সা ত্বকে শিশুদের গায়ে ‘রোজ স্পট’ নামে একটি অস্পষ্ট গোলাপি রঙের ফুসকুড়ি দেখা যেতে পারে, যা চাপ দিলে বিবর্ণ হয়ে ওঠে।
প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা ও চিকিৎসা
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে টাইফয়েড জ্বর নিশ্চিত হলে, সঙ্গে সঙ্গেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ক্লিনিক্যাল ভিত্তিতে টাইফয়েড প্রবলভাবে সন্দেহ করলে, ব্লাড কালচার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা হয়, কারণ এই রিপোর্ট আসতে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে।
তবে মনে রাখতে হবে, অন্যান্য সংক্রমণের মতো টাইফয়েড জ্বরে তাপমাত্রা ২-৩ দিনের মধ্যে দ্রুত স্বাভাবিক হয় না। সঠিক ওষুধ শুরু করার পরেও তাপমাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং এক সপ্তাহ পর্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, রোগ নির্ণয় নিশ্চিত না হলে, টাইফয়েড ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা তা জানতে আরও পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
কখন হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন?
টাইফয়েড জ্বরের সব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নাও হতে পারে। যদি রোগ হালকা হয় এবং দ্রুত শনাক্ত করা যায়, তবে মুখের ওষুধেই তা ভালো হয়।
তবে টাইফয়েড মূলত অন্ত্রের একটি সংক্রমণ, যা অন্ত্রনালিকে ফুলিয়ে দেয়। তাই মুখে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক (সিরাপ বা ট্যাবলেট) অনেক সময় ঠিকমতো শোষণ হতে পারে না। ফলে ওষুধ কাজ করতে ব্যর্থ হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হয়, যার জন্য অবশ্যই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।
যদি শিশু খুব দুর্বল বোধ করে, ঠিকমতো খেতে না পারে অথবা বমি করে, তাহলেও ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক এবং গ্লুকোজ বা স্যালাইন ইনফিউশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। টাইফয়েড জ্বরের জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদেরও সম্পূর্ণ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবশ্যক।
পুনরাবৃত্তি বা ‘রিল্যাপস’ টাইফয়েড
সঠিক চিকিৎসা এবং সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও ৫-১০ শতাংশ রোগীর মধ্যে আবার জ্বর দেখা যেতে পারে, যাকে রিল্যাপস (Relapse) টাইফয়েড বলে। এটি সাধারণত জ্বর চলে যাওয়ার ২-৩ সপ্তাহ পরে ঘটে। কদাচিৎ, প্রাথমিক সংক্রমণের কয়েক মাস পরেও টাইফয়েড আবার হতে পারে। সাধারণত, রিল্যাপস টাইফয়েড মূল টাইফয়েডের তুলনায় হালকা হয় এবং একই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এর চিকিৎসা করা উচিত। খুব কম ক্ষেত্রে, টাইফয়েড জ্বরের একটি দীর্ঘস্থায়ী রিল্যাপিং ফর্ম অনেক মাস ধরে স্থায়ী হতে পারে, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের অপর্যাপ্ত ডোজ দিয়ে চিকিৎসা করা হলে।
প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক
যেখানে পয়ঃনিষ্কাশন বা স্যানিটেশন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, সেখানে টাইফয়েডের বিস্তার রোধ করতে জল, স্যানিটেশন এবং হাইজিন (WASH) অপরিহার্য। তবে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের জন্য টিকা বা ভ্যাকসিন অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে।
ফোটানো জল: যেহেতু টাইফয়েড জল ও খাদ্যবাহিত রোগ এবং টাইফয়েড-আক্রান্ত রোগীদের মল বা প্রস্রাবে এই জীবাণু থাকে যা জল সরবরাহ ব্যবস্থাকে দূষিত করতে পারে (বিশেষ করে বর্ষাকালে), তাই পান করার আগে জল ফুটিয়ে পান করা উচিত।
খাদ্য পরিহার: বাসি, খোলা বা কম রান্না করা খাবার, কাঁচা শাকসবজি বা দূষিত দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: টয়লেট শেষে, খাওয়ার বা শিশুকে খাওয়ানোর আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। একইভাবে, ব্যবহারের আগে প্লেট, বাটি, চামচ ইত্যাদি পরিষ্কার সাবান-জল দিয়ে ধোয়াও প্রয়োজন।
টিকা: টাইফয়েড ভ্যাকসিন বা টিকা টাইফয়েড থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে দুই ধরনের টাইফয়েড ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পাওয়া যায় – টাইফয়েড পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন এবং টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV)। সাধারণত টাইফয়েড টিকা ২ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্য সুপারিশ করা হয় এবং এটি প্রতি ৩ বছর পরে পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বিকল্পভাবে, TCV শিশু ৬ মাসের পর থেকে দেওয়া যায় এবং নির্দেশিকা অনুসারে এর কোনো বুস্টার ডোজের দরকার হয় না। টাইফয়েড টিকা টাইফয়েড প্রতিরোধে সহায়তা করে। আপনার শিশুর জন্য কোনটি উপযুক্ত, তা জানতে সর্বদা আপনার শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।