শৃঙ্খলা মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য। একটি দেশের পরিচয় ফুটে ওঠে তার নাগরিকদের আচরণে। আমরা যদি কেবল নিজেদের নয়, দেশের এবং দশের কথা ভাবি, তবেই আমরা একজন প্রকৃত সুনাগরিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। শুদ্ধ হওয়া কোনো জন্মগত বিষয় নয়, এটি এক নিরন্তর চর্চা। একজন সফল শিল্পী বা ক্রীড়াবিদ যেমন সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করেন, তেমনই একজন ভালো মানুষ হতে গেলে প্রয়োজন অনুশীলন।
রাস্তায় প্রতিদিন আমরা একে অপরের মুখোমুখি হই। আমাদের আচরণেই তৈরি হয় সমাজের ছবি। বিশেষ করে যানবাহন চালক, তাদের সহযোগী ও কন্ডাক্টরদের ভূমিকা এক্ষেত্রে অপরিসীম। আসুন জেনে নিই, একজন শুদ্ধ মানুষ হিসেবে রাস্তায় তাদের জন্য ২১টি পথনির্দেশ, যা বদলে দিতে পারে আমাদের যানজটপূর্ণ শহরের চিত্র এবং নিয়ে আসতে পারে এক চমৎকার পরিবর্তন:
যানবাহন চালক ও সহযোগীদের জন্য সুনাগরিকের ২১টি পথনির্দেশ:
১. আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন: ট্রাফিক আইন মেনে চলা কেবল দায়িত্ব নয়, আপনার এবং অন্যের জীবনের সুরক্ষাও বটে। ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবসময় হালনাগাদ অবস্থায় সঙ্গে রাখুন।
২. যাত্রার আগে প্রস্তুতি: গাড়ি চালানোর শুরুতে সবকিছু ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, জ্বালানি পর্যাপ্ত আছে কিনা তা দেখে নিন। আপনার প্রস্তুতি অন্যের যাত্রাকে নিরাপদ করে।
৩. গাড়িতে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ: গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলবেন না। আপনার এক মুহূর্তের অসাবধানতা কেড়ে নিতে পারে অনেকগুলো জীবন।
৪. নীরবতার মূল্য বুঝুন: হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে অযথা হর্ন বাজিয়ে পরিবেশ দূষণ করবেন না। রোগীর বিশ্রাম এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি সংবেদনশীল হন।
৫. অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়: সবার আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামবেন না। অন্য যানবাহনকে ধাক্কা দেবেন না, কোণঠাসা করবেন না। নির্দিষ্ট লেন মেনে চলুন। প্রয়োজনে অন্য গাড়িকে আগে যেতে দিন। মনে রাখবেন, গন্তব্যে পৌঁছানোই আসল, জেতা নয়।
৬. হর্নের সদ্ব্যবহার: অযথা হর্ন বাজাবেন না। সিগন্যাল ছাড়ার পরও সামনের গাড়িকে দ্রুত যাওয়ার জন্য অযথা হর্ন দিতে থাকবেন না। শুধু প্রয়োজনে ও সহনীয় মাত্রায় হর্ন ব্যবহার করুন। পথচারীদের সাবধান করতে দূর থেকেই হর্ন বাজান, ঠিক পেছনে এসে হঠাৎ হর্ন দিয়ে তাদের আতঙ্কিত করবেন না।
৭. শব্দ দূষণ রোধে সচেতনতা: গাড়িতে রেডিও বা গান বাজালে শব্দ যেন শুধু গাড়ির ভেতরেই শোনা যায় এমন মাত্রায় রাখুন। আপনার বিনোদন যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়।
৮. সহিংসতা নয়, সমঝোতা: অন্য কোনো বাহনের সঙ্গে ধাক্কা বা আঁচড় লাগলে রাস্তায় নেমে হইচই না করে যথাসম্ভব শান্তভাবে তা মীমাংসা করুন এবং পরবর্তী করণীয় ঠিক করুন। ধৈর্য ধরুন।
৯. ধন্যবাদ ও সহানুভূতি: পথচারী বা অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা ঠেকাতে হঠাৎ ব্রেক করতে হলে কোনো কটু মন্তব্য বা গালি ছুড়বেন না। আপনার ভদ্রতা আপনার পেশার সম্মান বাড়াবে। যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছে আপনাকে ধন্যবাদ দিলে আপনিও প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ দিন এবং তাদের কাছে দোয়া কামনা করুন।
১০. নির্ধারিত স্থান ও নিরাপত্তা: নির্ধারিত স্টপেজে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তুলুন। গাড়ি এমনভাবে চালান যেন কাদা বা জল পথচারীর গায়ে ছিটকে না আসে। পাবলিক বাসে গায়ে হাত দিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো থেকে বিরত থাকুন, এটি নারীর প্রতি অসম্মানজনক।
১১. সহযোগীর প্রতি বিশ্বাস: সহযোগী বা হেলপারকে গাড়ি চালাতে দিয়ে নিজে (চালক) চা-সিগারেটের বিরতিতে যাবেন না। আপনার অনুপস্থিতিতে ঘটা দুর্ঘটনার দায় আপনারই।
১২. বিশেষ মানুষের প্রতি যত্ন: শিশু, মহিলা ও প্রবীণ যাত্রী ওঠা-নামার সময় ট্যাক্সি বা গাড়ির দরজা খুলে দিতে সচেষ্ট থাকুন। ওঠা-নামার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিন। তাদের প্রতি আপনার সহমর্মিতা এক মানবিক সমাজের ছবি তুলে ধরবে।
১৩. অসহায়ত্বের সুযোগ নয়: হাসপাতাল, ব্লাড ব্যাংকের সামনে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, লঞ্চ ঘাট, বাস স্ট্যান্ডে যাত্রীদের বিপদ বা অসহায়ত্বের সুযোগ নেবেন না। মানুষের দুর্দশায় পাশে দাঁড়ান, শোষণ করবেন না।
১৪. যাত্রীর জিনিস ফেরত দিন: আপনার বাহনে যাত্রী ভুলবশত কিছু ফেলে গেলে তা ফেরত দিতে সচেষ্ট থাকুন। আপনার সততা আপনার পেশাকে মহিমান্বিত করবে।
১৫. নিয়মের বাইরে নয়: উড়ালসড়ক বা ফ্লাইওভারে যানবাহন থামিয়ে যাত্রী নামাবেন না। এটি যেমন বিপজ্জনক, তেমনই আইন লঙ্ঘন। নির্ধারিত গতিসীমার মধ্যে থেকেই গাড়ি চালান।
১৬. ফুটপাতে অনধিকার প্রবেশ নয়: রিকশা, সাইকেল বা মোটরসাইকেল নিয়ে রোড ডিভাইডার বা সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে পার হবেন না। মূল রাস্তায় জ্যাম থাকলেও ফুটপাতে সাইকেল বা মোটরসাইকেল তুলে দেবেন না। ফুটপাত শুধু পথচারীদের জন্যেই।
১৭. শর্টকাট মানেই লাভ নয়: অহেতুক শর্টকাট খুঁজবেন না। ছোট গলিতে বড় গাড়ি ঢুকিয়ে অন্যদের চলাচলের পথ আটকে রাখবেন না। এতে জ্যাম আরও বাড়ে।
১৮. জেব্রা ক্রসিংকে সম্মান: ট্রাফিক সিগনালে জেব্রা ক্রসিং ঢেকে গাড়ি দাঁড় করাবেন না। পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার অধিকারকে সম্মান করুন।
১৯. ভাড়ায় সততা: ভাড়া ঠিক করে যাত্রী তুলুন। লোভে পড়ে বা যাত্রীকে হেনস্থা করার উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করবেন না। ভাড়ায় বনিবনা না হলে কটু মন্তব্য করবেন না, শান্তভাবে বিষয়টি মীমাংসা করুন।
২০. প্রযুক্তি ব্যবহার করুন: অচেনা কোনো জায়গায় গেলে সম্ভব হলে সঙ্গে রোডম্যাপ রাখুন অথবা জিপিএস-এর সাহায্য নিন। এটি আপনাকে সঠিক পথে যেতে সাহায্য করবে এবং যাত্রীর সময় বাঁচাবে।
২১. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: মাঝপথে গাড়ি বিকল হয়ে গেলে সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানান। অন্যের সাহায্যকে মূল্য দিন।
এই ছোট ছোট নিয়মগুলো মেনে চললে শুধু আপনার পেশার প্রতি সম্মানই বাড়বে না, বরং সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজের রাস্তার চিত্রই বদলে যাবে। আপনি হয়ে উঠবেন এক আদর্শ সুনাগরিক, যার উপস্থিতি অন্যদের জন্যও অনুপ্রেরণা।