মুদ্রিত বই পড়লে শরীরের যেসব উপকার হয়, জানা উচিত আপনারও

ভালো মানের একটি বই মানে ভীষণ উপকারী একজন বন্ধু। জ্ঞান অর্জন, মনের জানালাকে প্রসারিত করা বা বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই বা নিউজপেপার থেকে আমরা অর্জন করতে পারি বাস্তব জ্ঞান। পুঁথিগত বিদ্যা জীবিকার জন্য দরকার। তবে নিজেকে বাস্তববাদী ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে জন্য সংবাদপত্র ও বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

আমাদের দেশে গৃহস্থালী কাজের দায়িত্ব, সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের ওপরেই থাকে। বাসার পুরুষ সদস্যটি অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু বাসার নারী সদস্যটির অধিকাংশ সময়ে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ থাকে না।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে অসংখ্য পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে। পরিণামে অনেক পরিবার থেকে কাজ চলে গেছে গৃহ পরিচারিকার। ফলে বাসার নারী সদস্যটির ওপরে বেড়ে গেছে কাজের চাপের পরিমাণ।

পুরুষ সদস্যটি বাসায় ফেরার পরে অনেকেই টক শো দেখেন, খবরের কাগজ পড়েন, বিভিন্ন ধরণের ম্যাগাজিন, পত্রিকাও পড়তে দেখা যায়। তবে বাসার নারী সদস্যটিকে দেখা যায় বাসার কাজ, সন্তানদের দেখাশোনা করতে গিয়ে খবরের কাগজ পড়া বা টক শো দেখার সময় পায়না।

নারী-পুরুষ সহ ঘরের সকল সদস্যকে নিউজ পেপারের পাশাপাশি মূদ্রিত বই পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেটের মাধ্যমেও নিউজপেপার, ই-বুক ইত্যাদি পড়া যায়। তবে ই-বুক স্ক্রিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখের জন্য ক্ষতিকর।

স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করলে আমাদের চোখের উপর পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। তবে মুদ্রিত বই পড়লে কোনো ধরনের ক্ষতি হয় না। বরং সুস্থ থাকতে চাইলে পড়তে হবে মুদ্রিত বই-

চিন্তা শক্তি বাড়ায়

আমরা যখন ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন বা টিভিতে কোন নাটক বা সিনেমা দেখি, তখন সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয় না। আমাদের কল্পনার চোখে কোনো ঘটনার পরে কোন দৃশ্য বা সংলাপ হবে, তা ভেসে ওঠে। তবে আমরা যখন স্ক্রিনে কিছু দেখি, তখন আমাদের কল্পনার চোখ সেভাবে কাজ করে না।

মুদ্রিত বই পড়ার সময় আমাদের চিন্তাশক্তি কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলোও সক্রিয় হয়। আমাদের বয়স যতো বাড়তে থাকে, বিশেষত চল্লিশের পর থেকে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ ও স্নায়ুগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। নিয়মিত মুদ্রিত বই পড়লে আমাদের চিন্তা ও মেধাশক্তি বৃদ্ধি হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা নিয়মিত বই পড়ে তাদের বার্ধক্যজনিত স্নায়বিক দুর্বলতা হয় তুলনামূলকভাবে কম।

মনোযোগ বাড়ায়

স্ক্রিনে আমরা যখন কিছু দেখি, তার থেকেও বেশি মনোযোগ দরকার হয় মুদ্রিত বই পড়ার সময়। ই-বুক বা নিউজপেপার পড়ার সময়েও আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ি। এই ধরনের চর্চা আমাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করে। দুঃখ, কষ্ট, হতাশা আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। বিষণ্নতায় ভুগলে মানুষ জরুরি কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। ভুলে যাবার প্রবণতা বেড়ে যায়।

নিয়মিত বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। তখন বিষণ্নতা ও হতাশা মস্তিষ্ককে দুর্বল করতে পারে না। আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। পিতা, স্বামী বা ভাইয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা মানুষকে করে তোলে পরাধীন।

আমাদের সমাজে পুরুষ মানুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে অর্থনৈতিকভাবে। অনেক সময় এই পরনির্ভরশীলতা থেকে তৈরী হয় দুঃখ-কষ্ট-বিষণ্নতা। নিয়মিত ভালো মানের বই পড়লে মানুষ হয়ে ওঠে বাস্তববাদী। অনেক দুঃখ কষ্টের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে অটুট মনোবল।

খুলে যায় মনের দরজা

একজন লেখক তার জীবনের বহুবিধ অভিজ্ঞতা, কল্পনা, জ্ঞান দিয়ে লেখেন একটি বই। আবার সংবাদপত্রেও থাকে সমাজের চারপাশের সমসাময়িক ঘটনা। আমরা অনেক সময় একজন মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পোস্ট বা কিছু কাজকর্ম দেখে তাকে ভালো মানুষ হিসেবে ভেবে নিই।

একজন মানুষকে খুব ভালোভাবে না চিনে, না জেনে, সেই মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস করা উচিত নয়। আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে, যার বিস্তারিত লেখা থাকে সংবাদপত্রের পাতায়। পুরুষ মানুষেরা জীবিকার জন্য অধিকাংশ সময় থাকেন বাসার বাইরে। তারা পৃথিবীর চেহারা, বহুবিধ মানুষের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।

তবে এদেশের সিংহভাগ নারী এখনো গৃহিনী। বাসার বাইরের মানুষের সঙ্গে মেশার থাকে না সুযোগ। ফলে বিপদে পড়া বা ভুল পথে পা বাড়ানোর পরিমাণ পুরুষের তুলনায় নারীদের থাকে বেশি। তাই চাকরিজীবি, গৃহিণীসহ সব পেশার নারীকে নিয়মিত সংবাদপত্র ও মুদ্রিত বই পড়ার চেষ্টা করতে হবে।

মেধার বিকাশ ঘটে

বিসিএস পরীক্ষা, শব্দের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য, সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য সংবাদপত্র ও ভালো মানের বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। ছেলে-মেয়েদেরকে লেখাপড়াতে সহযোগিতা করার জন্য, পিতা-মাতাকে জানাতে হবে বিভিন্ন বিষয়। বিজ্ঞজনদের কাছে থেকে পরামর্শ নিয়ে অথবা গুগলের সাহায্যে নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য উপযুক্ত কোন বই তা জানা যায়।

মুদ্রিত বই কেনা সম্ভব না হলে ই-বুক থেকে পড়তে পারেন। তবে মুদ্রিত বই সব বয়সের মানুষের চোখের জন্য উপকারী। স্ক্রিন অতিমাত্রায় ব্যবহারের জন্য আমাদের ড্রাই আই নামের এক ধরনের চোখের অসুখ হয়। চোখে জ্বালা পোড়া, ব্যথা, চুলকানি ও মাথাব্যথা হতে পারে। চোখে ঝাপসাও লাগতে পারে। মুদ্রিত বই বা মুদ্রিত সংবাদপত্র পড়লে ড্রাই আই হওয়ারর সম্ভাবনা থাকে কম।

দিক নির্দেশনা মেলে

বইয়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও ঘটনার বিস্তৃতি থাকে। বেই পড়ে সেসব ঘটনার অভিজ্ঞতা লাভ করে। পরিণামে মানুষের মাঝে তৈরি হয় ভালো মন্দের বিচার করার মানসিক শক্তি। যে মানুষ যতো বেশি মানুষের সঙ্গে মিশবে, যতো বেশি বই আর নিউজপেপার পড়বেন তিনি মানুষকে সহজেই বুঝতে পারবেন।

কিশোর বয়স থেকেই পরিবারের সবার মাঝে সংবাদপত্র আর মুদ্রিত বই পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। জীবন যে কতোটা জটিল আর কঠিন, কিশোর বয়স থেকেই আমরা যেন আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বাস্তববাদী হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, আমাদেরকে সেই চেষ্টা করতে হবে।

মন নিয়ন্ত্রণে থাকে

অতিরিক্ত দুঃখ-কষ্ট, বিষণ্নতায় মন অস্থির থাকে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে কোনো বই পড়ে, তখন তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো সক্রিয় হয়। মানুষ সামান্য হলেও ভুলতে পারে তার কষ্ট। এজন্য বই পড়ার মাধ্যমে আপনি সহজেই মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।

বই পড়ার জন্য যুক্ত হতে পারেন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর সঙ্গেও। আজকাল বিশ্ব সাহ্যিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আছে দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলাতে। প্রতি মাসে ১০ টাকা চাঁদার বিনিময়ে বই পড়া যায়। নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে প্রতি সপ্তাহে আসে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বাস। আপনি নিজে সদস্য হতে পারেন, আপনার সন্তানকেও সদস্য বানাতে পারে।

পৃথিবী বরেণ্য অগণিত লেখকের বই থাকে এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীতে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন, ক্লাবের মাধ্যমেও বই পড়া যায়। অনেক জায়গায় পাঠাগার থাকে। যেখানে সদস্য হলে বই বাসায় এনে পড়া যায়। আর বই কেনার টাকা থাকলে, বইয়ের দোকানে যাবার সময় না পেলে, অনলাইন শপিং এর মাধ্যমেও কিনতে পারেন আপনার পছন্দের বই।

বর্তমানে রকমারি ডট কম, প্রথমা ডট কম, দারাজসহ বহুবিধ অনলাইন শপিং এর মাধ্যমেও বই কেনা যায়। নতুন বই কিনতে টাকা বেশি খরচ হবে মনে হলে, বিভিন্ন স্থানে থাকে পুরোনো বই কেনার বাজার। এসব স্থান থেকেও বই কিনতে পারেন। যেহেতু করোনা এখনো নির্মূল হয়ে যায়নি, তাই যেখানে থেকেই বই কেনেন না কেন, ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

ই-বুকের তুলনায় মুদ্রিত বই ছোট বড় সবার চোখের জন্য ভালো। তাই ছোট বড় সবাইকে মূদ্রিত বই পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। শুধু বইমেলা চলাকালীন সময় বা ভাষা দিবসের মাসে নয়, সারা বছর আমরা যেন ভালো মানের বই পড়তে পারি, নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। দেশি লেখক বা ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিদেশি লেখকদের বইও পড়তে হবে। আমরা যতো বেশি পড়বো, আমাদের চিন্তা-চেতনা আর জ্ঞানের পরিধী হবে ততোটাই ব্যাপক।

ওজন নিয়ন্ত্রণে আনে

ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিন ব্যবহার করলে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম হয় কম। হরমোন বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনে সময় কাটানা তাদের শারীরিক পরিশ্রম কম হয় ফলে ওজন বেড়ে যাওয়াসহ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের বেড়ে যায়।

অনিদ্রা দূর করে

যাদের অনিদ্রার সমস্যা আছে তাদেরকে ঘুমানোর আগে বই পড়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে অতিমাত্রায় স্ক্রিনে কাজ বা লেখাপড়া করলে কিংবা গেম খেললে সব বয়সের মানুষের মধ্যে তৈরি হতে পারে নিদ্রাহীনতা। ফলে মাথাব্যথা, চোখে ও ঘাড়ে ব্যথা, মেরুদণ্ডের নানা সমস্যাও হতে পারে।

Related Posts

© 2024 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy