পাইলস: আধুনিক চিকিৎসায় ব্যথাহীন উপশম কি সম্ভব?

পায়ুপথের জটিল রোগগুলোর মধ্যে পাইলস অন্যতম, যা নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে অনেককেই প্রভাবিত করে। পায়ুপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ, ফুলে যাওয়া, ব্যথা, চুলকানি, এবং পাইলস বেরিয়ে আসার মতো উপসর্গগুলো রোগীরা সাধারণত অনুভব করেন। এই উপসর্গগুলো দীর্ঘমেয়াদে জিইয়ে রাখলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, যার ফলে অনেক সময় অস্ত্রোপচার জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু মলদ্বার না কেটেই কি পাইলসের আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন আরএ স্পেশালাইজড হাসপাতালের কোলোরেক্টাল সার্জন অধ্যাপক ডা. রকিবুল মোহাম্মদ আনোয়ার।

পাইলসের মাত্রা ও প্রচলিত চিকিৎসা
ডা. রকিবুল মোহাম্মদ আনোয়ার জানান, পাইলস পায়ুপথ দিয়ে কতটা বেরিয়ে আসে তার ওপর নির্ভর করে একে চারটি মাত্রায় বিভক্ত করা হয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতিও বহুলাংশে এই মাত্রার ওপর নির্ভরশীল।

প্রথম মাত্রা: শুধুমাত্র পায়ুপথে রক্তক্ষরণ হয়, কিন্তু পাইলস কখনোই বাইরে বেরিয়ে আসে না।
দ্বিতীয় মাত্রা: মলত্যাগ করার সময় পাইলস পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু মলত্যাগ শেষ হওয়ার পর নিজে থেকেই আবার ভেতরে চলে যায়।
তৃতীয় মাত্রা: মলত্যাগ করার সময় পাইলস বাইরে আসে এবং রোগীকে আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে সেটি আবার ভেতরে ঢোকাতে হয়।
চতুর্থ মাত্রা: পাইলস সবসময় পায়ুপথের বাইরে অবস্থান করে।
প্রথম মাত্রা এবং প্রথমাবস্থায় দ্বিতীয় মাত্রা পাইলসের চিকিৎসা:
সাধারণত ইনজেকশন ও ব্যান্ড লাইগেশন পদ্ধতির মাধ্যমে এই ধরনের পাইলসের চিকিৎসা করা হয়। এর পাশাপাশি, খাদ্য অভ্যাস এবং জীবনধারায় পরিবর্তন এনে নরম কিন্তু শক্ত অথবা পাতলা নয় এমন মলত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের পাইলস আরোগ্য করা সম্ভব।

অগ্রবর্তী মাত্রার পাইলস এবং আধুনিক শল্যচিকিৎসা
অগ্রবর্তী দ্বিতীয় মাত্রা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ মাত্রার পাইলস কেবল শল্যচিকিৎসার মাধ্যমেই আরোগ্য করা সম্ভব।

ঐতিহ্যবাহী অস্ত্রোপচার (মিলিগান ও মরগানের পদ্ধতি):
১৯৩৭ সালে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের শল্যচিকিৎসকদ্বয় মিলিগান এবং মরগান পায়ুপথের তিন অবস্থানে চর্মসহ অভ্যন্তরীণ অংশ কেটে ফেলে পাইলসের আরোগ্য করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই অপারেশনের পর প্রচণ্ড ব্যথা হয়, বিশেষ করে মলত্যাগের পর। ঘা শুকাতে দেড় থেকে দু’মাস সময় লাগে, এবং ঘন ঘন মলত্যাগ বা মলত্যাগের অনুভূতি এলেই দ্রুত টয়লেটের দিকে ধাবিত হতে হয়। অনেক সময় অপারেশনের পর দেড় থেকে দু’মাসের আগে কাজে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, যা পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। জটিলতার ফলে মলদ্বার সংকুচিত হয়ে যেতে পারে অথবা মল আটকে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে রোগীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।

আধুনিক অস্ত্রোপচার (ডা. এন্টোনিও লংগোর পদ্ধতি):
১৯৯৩ সালে ইতালির প্যালেরমো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. এন্টোনিও লংগো নতুন এক অত্যাধুনিক অপারেশন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতিতে মলদ্বারে কোনো ক্ষত করা হয় না, চর্ম বা মাংস কাটা হয় না। এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিকে ‘স্ট্যাপলেড হেমোরহাইডেকটমি’ অথবা ‘স্ট্যাপলেড হেমোরহাইডোপেক্সি’ নামে অভিহিত করা হয়।

এই পদ্ধতি অস্বাভাবিকভাবে বর্ধিত হেমোরয়ডিয়াল (পাইলস) টিস্যু অপসারণ করে এবং অবশিষ্ট পাইলস টিস্যুকে তার স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। এতে করে পাইলসের স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরে আসে এবং রোগী উপসর্গমুক্ত হন।

প্রফেসর লংগো বিশ্বাস করেন যে পায়ুপথ হতে বেরিয়ে আসা পাইলসকে ঝুলেপড়া মাংসপিণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কোষ্ঠকাঠিন্য, গর্ভাবস্থা এবং অন্যান্য কারণে উপর্যুপরি আঘাতে পাইলসের পরিপোষক বন্ধনীগুলো দুর্বল হতে শুরু করে, সঙ্গে সঙ্গে পাইলসগুলোও ঝুলে পড়তে থাকে। তখন সামান্য ঘর্ষণে পাইলসের মধ্যকার শিরা থেকে রক্ত ঝরা শুরু হয়, যে রক্তের পরিমাণ অল্প থেকে প্রচুর হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

লংগোর পদ্ধতিতে ঝুলেপড়া পাইলসকে আগে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয় এবং পাইলসের রক্ত সঞ্চালনকে বাধাগ্রস্ত করে ফুলে যাওয়া রক্তনালিগুলোকে শুকিয়ে দেওয়া হয়। যে অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে অপারেশন করা হয়, সেটি মলদ্বারের বাইরে কোনো কাটাছেঁড়া করে না। বরং মলদ্বারের ভিতরে পায়ুপথ থেকে প্রায় দেড় ইঞ্চি উপরে একটি অংশ চক্রাকারে কেটে নেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে কাটা জায়গার প্রান্ত টাইটেনিয়াম দ্বারা তৈরি সূক্ষ্ম স্টেপেল দিয়ে জোড়া দেওয়া হয়। যে স্থানে কাটা ও জোড়া দেওয়া হয়, সেখানে ব্যথার স্নায়ু/পেইন ফাইবার থাকে না, যার ফলে অপারেশনের পর রোগী ব্যথাহীন থাকেন অথবা যৎসামান্য ব্যথা অনুভূত হয়। ঘা শুকানোর প্রশ্ন আসে না এবং রোগী দ্রুত কাজে ফিরে যেতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy