বহু দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা চিনিযুক্ত খাবারকে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। তবে সেই যুক্তির ব্যাখ্যা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি ফরাসী বিজ্ঞানী ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে এক উদ্বেগজনক তথ্য। গবেষণাটি বলছে, চিনি এবং চিনি মেশানো পানীয় গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, চিনি খাওয়ার সাথে সাথে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগের সম্ভাবনাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের দাবি, রক্তে চিনির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াই সম্ভবত ক্যান্সারের মূল কারণ। গবেষকরা সেই সমস্ত পানীয়কে ‘চিনিযুক্ত পানীয়’ হিসেবে গণ্য করেছেন যেগুলিতে ৫% এর বেশি চিনি রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চিনি মেশানো ফলের রস, বিভিন্ন প্রকার সফট ড্রিঙ্কস, মিষ্টি মিল্কশেক, এনার্জি ড্রিঙ্কস এবং চিনি দেওয়া চা ও কফি।
অন্যদিকে, চিনি গ্রহণের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা চালিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ফলে মানব শরীরে বিভিন্ন প্রকার বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের আধিক্য, ফ্যাটি লিভার, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং বার্ধক্য প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়ার মতো বিভিন্ন বিপাকজনিত রোগের সাথে চিনির সরাসরি যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন তারা। এই সমস্ত কারণের জন্যেই বিশ্বজুড়ে চিনি এখন ‘হোয়াইট পয়জন’ বা ‘সাদা বিষ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। গবেষণাটি অনুসারে, প্রতিদিন মাত্র ১০০ মিলি লিটার চিনিযুক্ত পানীয় (যা প্রায় দুটি ক্যানের সমান) গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি ১৮% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১,০০০ জন মানুষের মধ্যে ২২ জন ক্যান্সার রোগী চিনিযুক্ত পানীয় গ্রহণকারী ছিলেন। এই তথ্য থেকে স্পষ্টতই চিনিযুক্ত পানীয়ের সাথে ক্যান্সারের একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন যে, তামাক এবং অ্যালকোহলের মতোই চিনিও শরীরে আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে। যত বেশি চিনি খাওয়া হয়, মস্তিষ্ক তত বেশি করে তা খাওয়ার জন্য উদ্দীপ্ত হয়। চিনি গ্রহণের ফলে গ্রেলিন, লেপটিন ও ডোপামিনের মতো হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়, যা মস্তিষ্কে ক্ষুধার অনুভূতি বাড়িয়ে তোলে এবং মানুষ অতিরিক্ত খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়েছে যে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ কেবল ক্যান্সারের ঝুঁকিই বাড়ায় না, বরং মানুষের বুদ্ধিমত্তার উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশ্বজুড়ে চিনির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে সচেতনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের বহু স্কুল-কলেজ তাদের ক্যাফেটেরিয়ার ভেন্ডিং মেশিন থেকে ফাস্টফুড, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় ও বোতলজাত জুসের মতো অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাদ্যপণ্য সরিয়ে নিয়েছে, যাতে শিশু-কিশোরদের এই ধরনের খাবার গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা যায়।