শরীরের ভেতরে নীরবে বেড়ে চলা এক ‘শত্রু’ হলো কোলেস্টেরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের পক্ষে এর উপস্থিতি বোঝা কঠিন। আমাদের দেহে মূলত দু’ধরনের কোলেস্টেরল পাওয়া যায় – এইচডিএল (HDL) বা ‘ভালো’ কোলেস্টেরল, এবং এলডিএল (LDL) বা ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল। এই এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলেই রক্তনালি ব্লকের মতো ভয়াবহ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি জানি কোন খাবারগুলো এই খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায়, আর কোনগুলো আমাদের বন্ধু হয়ে রক্তে এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে?
চিকিৎসক ও পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বারবার জোর দিচ্ছেন খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের ওপর। তাদের মতে, রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে খাদ্যতালিকায় ‘বাজে চর্বি’ কমানো অত্যাবশ্যক। কিন্তু ‘বাজে চর্বি’ মানে কী? আর ‘ভালো চর্বি’ই বা কোনটি?
চর্বির রহস্য ভেদ: কোনটি বন্ধু, কোনটি শত্রু?
চর্বি মাত্রই খারাপ, এমন ধারণা ভুল। চর্বির মধ্যেও রয়েছে ভালো-মন্দের তফাৎ। সাধারণত, আমরা চর্বিকে সম্পৃক্ত (Saturated) এবং অসম্পৃক্ত (Unsaturated) চর্বি হিসেবে ভাগ করি:
শত্রু চর্বি (এলডিএল বাড়ায়): এগুলি হলো সম্পৃক্ত চর্বি এবং ট্রান্স ফ্যাট। মূলত লাল মাংসের চর্বি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ভাজাপোড়া এবং কিছু দুগ্ধজাত পণ্যে এগুলো বেশি থাকে। এই চর্বিগুলো রক্তে ‘খারাপ’ এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
বন্ধু চর্বি (এইচডিএল বাড়ায়, এলডিএল কমায়): এগুলি হলো অসম্পৃক্ত চর্বি, যেমন মনোআনস্যাচুরেটেড (Monounsaturated) এবং পলিআনস্যাচুরেটেড (Polyunsaturated) ফ্যাট। এই ধরনের চর্বি রক্তে ‘ভালো’ এইচডিএল কোলেস্টেরল বাড়াতে এবং ‘খারাপ’ এলডিএল কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা এক প্রকার পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
কোথায় পাবেন এই ‘ভালো চর্বি’?
ডায়েটে ভালো চর্বি যোগ করা মানেই তেলে ভাসা খাবার খাওয়া নয়, বরং সঠিক তেল বেছে নেওয়া। যদি তেল উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়, তাহলে সেগুলো সাধারণত ভালো চর্বিযুক্ত হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
সূর্যমুখী তেল: ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস।
ক্যানোলা অয়েল: ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের সুষম মিশ্রণ রয়েছে।
অলিভ অয়েল: মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডে ভরপুর, যা হার্টের জন্য খুবই উপকারী।
এছাড়াও, তৈলাক্ত মাছ (স্যামন, টুনা), বাদাম, অ্যাভোকাডো এবং কিছু বীজে (যেমন তিসি বীজ, চিয়া বীজ) ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, যা রক্তে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
তৈলাক্ত খাবার কি একেবারেই বন্ধ? চতুর নির্বাচনই আসল কথা
তাহলে কি আমরা তৈলাক্ত খাবার একেবারে খাব না? চিকিৎসকদের উত্তর স্পষ্ট: তৈলাক্ত খাবার আমরা অবশ্যই খাব, তবে বেছে নিতে হবে সেই তৈলাক্ত খাবারগুলো, যেগুলো আমাদের হার্টের জন্য ভালো এবং রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায় না। অর্থাৎ, ‘কী খাচ্ছি’ তার চেয়ে ‘কেমন চর্বি খাচ্ছি’ সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই, খাবারের ব্যাপারে সচেতন হন, চর্বি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করুন, এবং একটি সুস্থ হৃদপিণ্ড নিয়ে দীর্ঘজীবী হন।