যেসব নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে রয়েছে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, জেনেনিন আর সতর্ক থাকুন

দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কয়েক প্রকার পণ্যে বিশেষ একটি রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ক্রমশই বাড়ছে যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে বলে বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এই পদার্থটিকে খুব সহজে ধ্বংস হয় না বলে এটি দীর্ঘ সময় পরিবেশে থেকে যেতে পারে। এজন্য এটিকে চিরস্থায়ী কেমিক্যাল হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণে এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে ক্যান্সারসহ নবজাতকের জন্মগত ত্রুটিও দেখা দিতে পারে।

পিএফএএস বা পিফাস নামের এই রাসায়নিক পদার্থটি জল, তেল এবং দাগ প্রতিরোধ করতে পারে যে কারণে বিভিন্ন সামগ্রীতে এটি ব্যবহার করা হয়।

প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে নন-স্টিক ফ্রাইং প্যানের মতো হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে রূপসজ্জা বা মেকআপের নানা সামগ্রী।

এই রাসায়নিক পদার্থটির পুরো নাম পলি অ্যান্ড পারফ্লোরোয়ালকিল সাবটেন্স বা পিএফএএস যাকে সংক্ষেপে বলা হয় পিফাস।

বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক বাসা-বাড়িতে ও পরিবেশে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি এই ফ্লোরিন-ভিত্তিক যৌগিক পদার্থ পিফাস পাওয়া যায়।

খাবার-দাবারের প্যাকেট, রান্নার নন-স্টিক সামগ্রী, বৃষ্টিতে ভিজে না এরকম পোশাক যেমন রেইনকোট, আঠা, কাগজ এবং রঙ- এসব জিনিসে এই রাসায়নিক পদার্থটি ব্যবহার করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, ‘শিল্প বিপ্লবের পর যখন থেকে মানুষ তার জীবনযাত্রায় নানা ধরনের জিনিস ব্যবহার করতে শুরু করলো তখন থেকেই এর ব্যবহার বেশি করে শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় রান্নার হাড়ি-পাতিলে। কারণ এসব পাতিলে এই রাসায়নিকের একটি আস্তরণ দেয়া হয় যাতে এর গায়ে জল, তেল বা ময়লা লাগে না, এবং যার ফলে এসব সহজে পরিষ্কার করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়াও অগ্নি-নির্বাপণের জন্য যে ফোম ব্যবহার করা হয়, রং, কীটনাশক, শ্যাম্পু, ফটোগ্রাফি ও ফুড প্যাকেজিং- এসবেও এই রাসায়নিক পদার্থটি ব্যবহার করা হয়।

সম্প্রতি বৃষ্টির জলেও এই রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

একারণে বৃষ্টি খাবার জলের উৎস হিসেবে কতটা নিরাপদ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এই পিফাস যদি জলে ও মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে মিশে যায়, তাহলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

এই রাসায়নিকের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয় এবং এর ব্যবহার কত মাত্রায় পৌঁছালে তা বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে এসব নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ রসায়ন বিষয়ের অধ্যাপক এলসি সান্ডারল্যান্ড বলেন, ‘এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে মানবদেহের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ওপরেই এর প্রভাব পড়ে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ ড. সালাম বলেন, ‘পিফাসের অনেক ঝুঁকি আছে। অনেক ঝুঁকি সম্পর্কে এখনো জানাও যায়নি। কারণ এবিষয়ে এখনো গবেষণা চলছে।’

তিনি বলেন, ‘এই রাসায়নিক পদার্থটি নিয়ে গত ২০ বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। এর আগে এটি নিয়ে তেমন একটা উদ্বেগ ছিল না। সম্প্রতি এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও নীতিমালা তৈরি হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হচ্ছে, এর ফলে কিডনির ক্যান্সার হতে পারে, লিভারের ক্ষতি হতে পারে, নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে, হাঁপানি, থাইরয়েড, কোলেস্টোরেল, হাইপারটেনশন এমনকি গর্ভস্থ শিশুর মধ্যে জন্মগত ত্রুটিও দেখা দিতে পারে।

সমস্যা হচ্ছে পিফাসকে খুব সহজে ধ্বংস করা যায় না। কারণ এতে কার্বন ও ফ্লোরিনের অনেক বন্ড থাকে যেগুলো অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ড। এই বন্ডের কারণেই পিফাস জল ও তেল প্রতিরোধ করতে পারে।

পরিবেশের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই রাসায়নিক পদার্থের কোনো ধরনের ক্ষয় হয় না। ফলে এটি দীর্ঘ সময় ধরে মাটি, বাতাস, বৃষ্টি ও জলে থেকে থেকে যায়।

বর্তমানে ভস্মীভূত করার মাধ্যমে এই রাসায়নিকটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু এই প্রক্রিয়া খুব একটা সফল হয়নি।

এজন্য উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় যা ব্যয়বহুলও বটে।

এছাড়াও পিফাস পোড়ালে এথেকে কিছু উপজাত তৈরি হয় যেগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

সুখবর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাদের নতুন এক গবেষণায় বলেন, অল্প তাপমাত্রায় এবং অল্প খরচে এই পিফাস রাসায়নিক ধ্বংস করার একটি উপায় তারা উদ্ভাবন করেছেন।

তারা বলেন, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো একটি সাধারণ রাসায়নিক ব্যবহার করে পিফাসে কার্বন ও ফ্লোরিনের বন্ড ভেঙে দেয়া যায়।

সাবান ও ব্যথানাশক ওষুধ তৈরিতে এই সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ব্যবহার করা হয়।

বিজ্ঞানীদের দলটি আশা করছেন আরো গবেষণার মাধ্যমে খাবার জল থেকেও ক্ষতিকর এই রাসায়নিক পদার্থটিকে আলাদা করা সম্ভব হবে।

তবে ড. সালাম বলেন, পিফাস থেকে মুক্তির সহজ কোনো উপায় নেই।
প্রথম কথা হলো এটি যদি ব্যবহার না করি তাহলেই সবচেয়ে ভালো। কিন্তু বর্তমান যুগে এটা আর সম্ভব নয়। আমরা এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। একারণে এই রাসায়নিক পদার্থের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে, যেগুলো খুব সহজে ক্ষয় হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়াও পরিবেশের মধ্যেই এধরনের অনেক পদার্থ আছে যেগুলোতে জল আটকায় না, ঝরে পড়ে যায়, যেমন কচু-পাতা। অর্থাৎ এগুলোতেও এধরনের পদার্থ আছে এবং সেটাকে যদি সিনথেসিসের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারি তাহলেও পরিবেশের দূষণ কম হবে।’

বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের সমাজে যেসব জিনিসের ব্যবহার অপরিহার্য এবং যেগুলোর কোনো বিকল্প নেই শুধু সেগুলোতেই এই রাসায়নিকটি ব্যবহার করা উচিত।bs

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy