২৫শে মে, বিশ্ব থাইরয়েড দিবস— এই বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘থাইরয়েড ও যোগাযোগ’, যা এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি সম্পর্কে আরও জ্ঞান, সচেতনতা এবং সময়োচিত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ১০০০ নারীর মধ্যে প্রায় ১৫ জন এবং প্রতি ১০০০ পুরুষের মধ্যে ১ জন থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, থাইরয়েড এখন আর কোনো বিরল রোগ নয়, বরং এটি একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যগত উদ্বেগ।
থাইরয়েড কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
আমাদের স্বরযন্ত্রের ঠিক দু’পাশে, প্রজাপতির মতো দেখতে একটি বিশেষ গ্রন্থি হলো থাইরয়েড। এর প্রধান কাজ হলো শরীরের বিপাকীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রক অত্যাবশ্যকীয় থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করা। এই হরমোনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা শরীরে বজায় থাকা অত্যন্ত জরুরি। যখন থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন করে (হাইপোথাইরয়েডিজম) অথবা বেশি হরমোন উৎপাদন করে (হাইপারথাইরয়েডিজম), তখনই শরীরে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করে।
থাইরয়েডের সমস্যা শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে। থাইরয়েড রোগীরা প্রায়শই বিষণ্নতা, অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস, তীব্র ক্লান্তি, শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া, চুল পড়া, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা এবং সার্বিক শক্তির অভাব অনুভব করেন।
থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে যা করবেন ও যা করবেন না:
চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনযাত্রার সঠিক ব্যবস্থাপনা থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যা করবেন:
নিয়মিত পরীক্ষা: থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করানো আবশ্যিক। এমনকি, একটি বেসাল থার্মোমিটার দিয়ে ১০ মিনিটের তাপমাত্রা মেপে ঘরে বসেও প্রাথমিক ধারণা পেতে পারেন।
পর্যাপ্ত জল পান: থাইরয়েড রোগীদের জন্য পাতিত জল পান করা উপকারী, কারণ এতে ক্লোরিন, ফ্লোরাইড এবং ব্রোমিনের মাত্রা খুব কম থাকে, যা থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
সুষম খাদ্য: সেলেনিয়াম, টাইরোসিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার আপনার খাদ্যতালিকায় রাখুন। ভিটামিন B যুক্ত খাবারও থাইরয়েড রোগীদের জন্য অপরিহার্য।
পর্যাপ্ত ঘুম: দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
যা করবেন না:
ধূমপান ও অ্যালকোহল: এই দুটিই থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই এগুলো সম্পূর্ণ বর্জন করুন।
অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট: অতিরিক্ত চর্বি, বিশেষ করে ট্রান্স-ফ্যাট এবং ফ্যাটবিহীন খাবার থাইরয়েড রোগীদের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
চিনি ও ক্যাফেইন: অতিরিক্ত চিনি এবং ক্যাফেইন পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত TSH (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন) এর মাত্রায় পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যা থাইরয়েড সমস্যার জন্য ভালো নয়।
কিছু সবজি: ব্রোকোলি, বাঁধাকপি এবং ফুলকপির মতো কিছু সবজি থাইরয়েড রোগীদের জন্য উপকারী নয়। ওজন কমানোর জন্য অনেকেই এগুলো ডায়েটে রাখেন, কিন্তু থাইরয়েড থাকলে এগুলি পরিহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
প্যাকেটজাত ও প্রসেসড খাবার: এসব খাবারে অতিরিক্ত লবণ, চিনি এবং তেলের পরিমাণ বেশি থাকে, যা ওজন দ্রুত বাড়াতে পারে এবং থাইরয়েডের সমস্যাকে জটিল করতে পারে।
অতিরিক্ত ফাইবার: যদিও ফাইবার শরীরের জন্য উপকারী এবং ওজন কমাতেও সাহায্য করে, তবে থাইরয়েড রোগীদের ক্ষেত্রে অত্যাধিক ফাইবার গ্রহণ না করাই ভালো। আমেরিকানদের নির্দেশনা অনুযায়ী, ৫০ বছরের কম বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ২৫-৩৮ গ্রামের মধ্যে ফাইবার গ্রহণ করা উচিত।
দুগ্ধজাত পণ্য: বেশিরভাগ চিকিৎসকের মতে, দুধ, মাখন, চিজের মতো দুগ্ধজাত খাবার শরীরে হরমোনের ভারসাম্যকে আরও প্রভাবিত করতে পারে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
থাইরয়েড একটি নীরব ঘাতক হতে পারে, তবে সঠিক জ্ঞান, নিয়মিত পরীক্ষা এবং জীবনযাত্রার সুষম পরিবর্তনের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আসুন, বিশ্ব থাইরয়েড দিবসে আমরা সবাই এই রোগ সম্পর্কে আরও সচেতন হই এবং অন্যদেরও সচেতন করি।