লিভারের নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস, যা বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, আজ বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ‘হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না’ – এই দৃঢ় প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে এই ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলের এক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সকল দেশকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে।
বর্ষায় সতর্কতা: ডেঙ্গু-করোনার মাঝেও হেপাটাইটিসের ঝুঁকি
বর্ষার এই সময়ে ডেঙ্গু, করোনা সংক্রমণের সাথে সাথে হেপাটাইটিসের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। দূষিত জল ও খাবারের মাধ্যমেই মূলত এই রোগের বিস্তার ঘটে, যা প্রাথমিকভাবে কোনও লক্ষণ প্রকাশ না করলেও ধীরে ধীরে লিভারের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং মারাত্মক আকার ধারণ করে।
লক্ষণ: যখন নীরবতা ভাঙে
হেপাটাইটিস ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কিন্তু যখন দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ লিভারকে আক্রমণ করে, তখন কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে:
শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি
বমি বমি ভাব ও বমি
পেটে ব্যথা
ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)
হলুদ প্রস্রাব
রোগের বিস্তার বাড়লে পেটে জল আসা, রক্ত পায়খানা এবং রক্তবমি পর্যন্ত হতে পারে।
৫টি ধরন, ভিন্ন বিপদ
হেপাটাইটিসের পাঁচটি প্রধান ধরন রয়েছে: এ, বি, সি, ডি এবং ই। এর মধ্যে হেপাটাইটিস বি এবং সি সবচেয়ে মারাত্মক, যা লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের কারণ হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা না করা হলে লিভার সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
হেপাটাইটিস এ: দূষিত খাবার ও জলের মাধ্যমে ছড়ায়। লক্ষণ: লিভার ফোলা, ক্ষুধামন্দা, জ্বর, বমি, জয়েন্টে ব্যথা।
হেপাটাইটিস বি: রক্ত, ঘাম, লালা, বীর্য সহ বিভিন্ন দেহনিঃসৃত তরলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, পেটে ব্যথা, জন্ডিস এর প্রধান লক্ষণ। এটি দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগ, যা সিরোসিস ও ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। গর্ভবতী মায়ের মাধ্যমে শিশুও আক্রান্ত হতে পারে।
হেপাটাইটিস সি: হেপাটাইটিস এ এবং বি এর চেয়েও বিপজ্জনক। রক্ত আদান-প্রদান, দূষিত চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়ায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন থাকে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ লিভারের মারাত্মক ক্ষতি এবং সিরোসিস সৃষ্টি করে। এটি লিভার ফেইলিওর, ক্যান্সার বা খাদ্যনালীতে রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে, যা প্রাণঘাতী।
হেপাটাইটিস ডি: হেপাটাইটিস বি এবং সি আক্রান্ত রোগীদের জন্য এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দূষিত রক্ত, সংক্রামিত সূঁচ বা শেভিং কিট ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়ায়। লক্ষণ: বমি, হালকা জ্বর।
হেপাটাইটিস ই: দূষিত খাবার দ্বারা ছড়ায়। আক্রান্ত হলে ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, জন্ডিস এবং হালকা জ্বর হতে পারে।
সতর্কতা ও চিকিৎসা: ‘অপেক্ষা নয়, এখনই পদক্ষেপ’
বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, হেপাটাইটিসের লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ, ‘হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না’। সময়মতো শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা এই নীরব ঘাতককে মোকাবিলায় অপরিহার্য। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস-মুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হই।