বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের কারণে যত মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এটি পুরুষদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক নির্ণীত ক্যানসার এবং বিশ্বব্যাপী ক্যানসারজনিত মৃত্যুর পঞ্চম প্রধান কারণ। ক্যানসার ছাড়াও, পুরুষদের প্রোস্টেটে প্রদাহ (প্রোস্টাটাইটিস) এবং প্রোস্টেট বৃদ্ধির মতো গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তাই প্রোস্টেটের সুস্থতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
লক্ষণ যা উপেক্ষা করা উচিত নয়:
যদিও প্রোস্টেট ক্যানসার পুরুষদের মধ্যে দেখা যাওয়া ক্যানসারের অন্যতম প্রধান রূপ, এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। এই লক্ষণগুলি সাধারণ মনে হলেও, তা কিন্তু অবহেলা করা উচিত নয়। যেমন:
- প্রস্রাবের সমস্যা: প্রস্রাব করতে অসুবিধা, দুর্বল বা ধীর প্রস্রাবের প্রবাহ, ঘন ঘন প্রস্রাব, বিশেষ করে রাতে।
- ব্যথা: হাড়ে ব্যথা (বিশেষ করে পিঠ, নিতম্ব বা উরুতে), যা ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত হতে পারে।
- হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া: কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন হ্রাস।
- যৌন সমস্যা: ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গোত্থানে সমস্যা।
- রক্ত: প্রস্রাবে রক্ত (হেমাতুরিয়া) বা বীর্যে রক্ত (হেম্যাটোস্পার্মিয়া)।
- জ্বালাপোড়া: প্রস্রাব বা বীর্যপাতের সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা।
প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে বয়সের সম্পর্ক:
প্রোস্টেট ক্যানসারের ঘটনা এবং মৃত্যুর হার বয়সের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের মধ্যেই এই ক্যানসার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির (ACS) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬০% প্রোস্টেট ক্যানসার ৬৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের মধ্যে নির্ণীত হয় এবং ৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে এটি বিরল। তবে, সাম্প্রতিক গবেষণায় অল্পবয়সী পুরুষদের মধ্যেও এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, যা উদ্বেগের কারণ।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ইউএস প্রিভেন্টিভ সার্ভিসেস টাস্ক ফোর্সের অনুমান অনুযায়ী, ৫০-৫৯ বছর বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য (কিছু সমীক্ষায় ১০-৪২%)। অন্যদিকে, ৬০-৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সামগ্রিক ঝুঁকি ১৭-৬৬% পর্যন্ত হতে পারে।
কমবয়সীদের মধ্যে উদ্বেগজনক প্রবণতা:
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS), নিউ দিল্লি, ইন্ডিয়ার গবেষকদের দ্বারা ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষা কমবয়সীদের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঘটনার উপর আলোকপাত করে। এই সমীক্ষায় উঠে আসে, একজন ২৮ বছর বয়সী পুরুষের উচ্চ পর্যায়ের প্রোস্টেট ক্যানসার নির্ণয় করা হয়েছিল। যদিও তার তেমন সুস্পষ্ট লক্ষণ ছিল না, তবে মাঝে মাঝে তলপেটে ব্যথা, দুর্বল প্রস্রাবের বেগ, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, পিঠের নিচের দিকে ব্যথা এবং চাপের মতো লক্ষণ দেখা দিত। এই গবেষণাটি ‘কারেন্ট ইউরোলজি জার্নালে’ প্রকাশিত হয়েছিল, যা প্রমাণ করে প্রোস্টেট ক্যানসারকে আর কেবল ‘বার্ধক্যের রোগ’ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন যাদের প্রোস্টেট ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাদের জন্য। যেসব পুরুষদের বাবা বা ভাই প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। তাই এই শ্রেণীর পুরুষদের সর্বদা লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করতে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে বলা হচ্ছে।
যদিও বয়স্ক পুরুষরা অবশ্যই উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তবে খাদ্যাভ্যাস এবং অনিয়মিত জীবনযাত্রার মতো অন্যান্য অনেক কারণ অল্পবয়সীদের মধ্যেও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। হার্ভার্ডের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব পুরুষ প্রচুর লাল মাংস বা উচ্চ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খান, তাদের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।
প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়:
যদি আপনি প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন, তবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য: কম চর্বিযুক্ত, উচ্চ মৌসুমি ফল ও সবজি সমৃদ্ধ খাদ্য প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- দুগ্ধজাত পণ্য: বেশ কয়েকটি গবেষণায় দুগ্ধজাত পণ্য এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের মধ্যে একটি যোগসূত্র পাওয়া গেছে। যদিও এই বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে, কিছু গবেষণায় প্রতিদিন দুধ, পনির ও দই খাওয়া প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
- স্বাস্থ্যকর ওজন ও শারীরিক কার্যকলাপ: একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা এবং নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ প্রোস্টেট ক্যানসারসহ অন্যান্য অনেক রোগের ঝুঁকি কমায়।
প্রোস্টেট ক্যানসার একটি গুরুতর রোগ হলেও, প্রাথমিক লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এর ঝুঁকি কমাতে এবং সময়মতো রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।