আধুনিক জীবনযাত্রায় আমরা প্রায়শই ব্যস্ত থাকি, আর এর ফলে অবহেলিত হয় শরীরের ভেতরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায়শই উপেক্ষিত পুষ্টি উপাদান হলো ভিটামিন বি ১২, যা ‘কোবালামিন’ নামেও পরিচিত। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিরামিষাশীদের একটি বিশাল অংশ (৮০-৯০%) এই অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিনের অভাবে ভুগছেন। কিন্তু এর লক্ষণগুলো অনেক সময় এতটাই সূক্ষ্ম হয় যে সহজে ধরা পড়ে না, ফলে সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই ভিটামিন?
জলে দ্রবণীয় এই ভিটামিনটি রক্ত গঠন এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। অবাক করা বিষয় হলো, মানবদেহ নিজে এই ভিটামিন উৎপাদন করতে পারে না। তাই এটি অবশ্যই খাদ্য বা সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। দুঃখজনকভাবে, উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্যে ভিটামিন বি ১২ প্রায় অনুপস্থিত। এর অভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের কাজে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটে।
লক্ষণগুলো চিনবেন কীভাবে?
অনেক সময়ই ভিটামিন বি ১২ এর অভাবের উপসর্গগুলো এতটাই ধীরগতিতে প্রকাশ পায় যে অনেকে বুঝতেও পারেন না। চলুন দেখে নেওয়া যাক কিছু সাধারণ লক্ষণ:
বিভ্রান্তি ও মাথা ঘোরা: ভিটামিন বি ১২ রক্ত কোষ তৈরিতে সাহায্য করে, যা শরীরের প্রতিটি অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে। যখন লোহিত রক্তকণিকার অভাব হয়, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়, যার ফলে বিভ্রান্তি, মাথা ঘোরা এবং সিদ্ধান্তহীনতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ভিটামিন বি ১২ এর অভাবের একটি সাধারণ লক্ষণ।
বিষণ্নতা ও মেজাজের পরিবর্তন: গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন বি ১২ এর অভাবে মস্তিষ্কের ‘হোমোসিস্টিন’ টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলস্বরূপ মেজাজের আকস্মিক পরিবর্তন এবং বিষণ্নতা বাড়ে। পর্যাপ্ত ভিটামিন বি ১২ গ্রহণ করে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
মনোযোগের অভাব: হঠাৎ করে কোনো কাজে মনোযোগ দিতে অসুবিধা হচ্ছে? এর কারণ হতে পারে ভিটামিন বি ১২ এর অভাব। মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব এবং মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
ভুলে যাওয়া ও স্মৃতিভ্রম: যদি আপনি সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যাচ্ছেন বা কথা বলতে সমস্যা অনুভব করছেন, তবে এটি ভিটামিন বি ১২ এর অভাব এবং প্রাথমিক ডিমেনশিয়ার লক্ষণ হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করালে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার কারণ হতে পারে।
মুখের সমস্যা: ভিটামিন বি ১২ এর ঘাটতি মুখে অস্বাভাবিক লক্ষণ তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো ‘লিঙ্গুয়াল প্যারেস্থেসিয়া’, যেখানে জিহ্বা ফুলে যাওয়া বা জ্বালাপোড়ার সমস্যা দেখা দেয়। এটিকে ‘গ্লসাইটিস’ও বলা হয়।
কেন হয় এই অভাব?
ভিটামিন বি ১২ এর অভাবের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে:
১. পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া: এক্ষেত্রে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভুলবশত পেটের স্বাস্থ্যকর কোষগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়, যা ভিটামিন বি ১২ শোষণ করার জন্য জরুরি। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেলেও শরীর ভিটামিন শোষণ করতে পারে না।
২. অপর্যাপ্ত খাদ্যাভ্যাস: দ্বিতীয় কারণটি হলো আপনার খাদ্যে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি ১২ এর অভাব। যেহেতু এই ভিটামিন মূলত প্রাণীজ উৎস থেকে পাওয়া যায়, নিরামিষাশীদের ক্ষেত্রে এর অভাব দেখা দেওয়া খুবই সাধারণ।
কতটুকু ভিটামিন বি ১২ প্রয়োজন?
ভিটামিন বি ১২ এর দৈনিক চাহিদা বয়স অনুসারে পরিবর্তিত হয়:
৪-৮ বছর: ১.২ মাইক্রোগ্রাম
৯-১৩ বছর: ১.৮ মাইক্রোগ্রাম
১৪-১৮ বছর: ২.৪ মাইক্রোগ্রাম
প্রাপ্তবয়স্ক: ২.৪ মাইক্রোগ্রাম
গর্ভবতী হলে: ২.৬ মাইক্রোগ্রাম
বুকের দুধ খাওয়ালে: ২.৮ মাইক্রোগ্রাম
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
যদি আপনার মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
ত্বক ফ্যাকাশে দেখালে
দুর্বল বোধ করলে
চলাফেরায় সমস্যা হলে
প্রায়ই শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে
চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ভিটামিন বি ১২ এর অভাব নির্ণয় করতে পারেন এবং রিপোর্টের ভিত্তিতে ডায়েটে পরিবর্তন আনার বা প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন। ভিটামিন বি ১২ এর অভাব উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। সময়মতো সচেতন হোন এবং সুস্থ থাকুন।