বিশ্বজুড়ে মানুষের অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক উদ্বেগজনক অনুমান অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৩০-৭৯ বছর বয়সী ১.২৮ বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, এর প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষই নিজেদের এই অবস্থা সম্পর্কে সচেতন নন।
উচ্চ রক্তচাপ কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি কার্ডিওভাসকুলার রোগের এক প্রধান কারণ, যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এমনকি হার্ট ফেইলিয়রের মতো প্রাণঘাতী পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। WHO-এর রেকর্ড বলছে, অর্ধেকেরও কম প্রাপ্তবয়স্কদের (৪২ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়, এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রতি ৫ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন (২১ শতাংশ) তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন। যদিও এটি সবসময় প্রাণঘাতী নয়, জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই সমস্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু তার আগে, এর কিছু প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।
উচ্চ রক্তচাপের যে লক্ষণগুলো কখনো অবহেলা করবেন না:
১. অসহ্য মাথাব্যথা (ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশন): স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশন নামে এক গুরুতর অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক মাথাব্যথা সৃষ্টি করে। এই ব্যথা কমানো কঠিন এবং এটি জ্বর বা মাইগ্রেনের মাথাব্যথার চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির।
২. বুকে চাপ বা ব্যথা (এনজাইনা): উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যুক্ত বুকে ব্যথাকে ‘এনজাইনা’ বলা হয়। এটি অন্য কোনো সংক্রমণের কারণে হওয়া ব্যথার মতো নয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে বুকে চেপে ধরা, চাপ, ভারী হওয়া, বা বুকে ব্যথা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। এনজাইনা পেক্টোরিস নামে পরিচিত এই অবস্থা হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল কমে গেলে দেখা দেয়।
৩. ঝাপসা দৃষ্টি: চোখের উপর উচ্চ চাপের প্রভাব: উচ্চ রক্তচাপ সরাসরি দৃষ্টিশক্তিকে প্রভাবিত করে। এটি চোখের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি হয়। যদি উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে সচেতন না হন কিংবা সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে না রাখেন, তাহলে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তির গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে।
৪. একটানা ক্লান্তি: শরীরের নীরব সংকেত: ক্লান্তি শরীরের প্রায় প্রতিটি অসুস্থতার সঙ্গেই যুক্ত। তবে একটানা, অস্বাভাবিক ক্লান্তি একটি ভালো লক্ষণ নয়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা প্রায়শই ক্লান্তিতে ভোগেন। বেশিরভাগ মানুষই একে অবহেলা করেন, কিন্তু মনে রাখবেন, সামান্য ক্লান্তিও বিভিন্ন গুরুতর রোগের ইঙ্গিত হতে পারে। তাই এই লক্ষণ কখনো অবহেলা করবেন না।
অন্যান্য জরুরি লক্ষণসমূহ:
উপরিউক্ত প্রধান লক্ষণগুলো ছাড়াও, উচ্চ রক্তচাপের আরও কিছু ‘নীরব’ উপসর্গ রয়েছে যা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করা উচিত:
নাক দিয়ে রক্ত পড়া: ঘন ঘন বিনা কারণে নাক দিয়ে রক্ত পড়া উচ্চ রক্তচাপের একটি লক্ষণ হতে পারে।
অনিয়মিত হৃদযন্ত্রের ছন্দ: হার্টবিট অস্বাভাবিক দ্রুত বা ধীর হওয়া, বা অনিয়মিত স্পন্দন।
কানে বিভিন্ন শব্দ শোনা: কানে ক্রমাগত ভোঁ ভোঁ বা হিসহিস শব্দ শুনতে পাওয়া।
বমি বমি ভাব বা বমি: হজমজনিত সমস্যা না থাকলেও হঠাৎ করে বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
বিভ্রান্তি: হঠাৎ করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বা মনে রাখতে সমস্যা হওয়া।
দুশ্চিন্তা: অকারণে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা অস্থিরতা অনুভব করা।
পেশি কম্পন: হাত-পা কাঁপা বা পেশিতে অস্বাভাবিক কম্পন অনুভব করা।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ: এক নীরব ঘাতকের পরিণতি
উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয় তার এই অলক্ষ্যে এগিয়ে চলার ক্ষমতার জন্যই। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহু গুণ বেড়ে যায়। হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে হার্টের পেশির কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ।
অন্যদিকে, হার্ট ফেইলিউর ঘটে যখন হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেন পাম্প করতে পারে না। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহকারী ধমনী ফেটে গিয়ে স্ট্রোকও হতে পারে, যা পক্ষাঘাত বা এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
আপনি যদি নিয়মিত রক্তচাপ না মাপেন, তবে উচ্চ রক্তচাপ সহজে ধরা পড়বে না এবং শারীরিক জটিলতা বাড়তেই থাকবে। তাই, নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করুন এবং এই প্রাথমিক লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমেই হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও অন্যান্য গুরুতর শারীরিক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। আপনার জীবন আপনার হাতে, সময় থাকতেই সতর্ক হন।