আজ বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস, নীরব ঘাতক হেপাটাইটিসকে অবহেলা নয়, এই বর্ষায় সতর্ক থাকুন লিভারের এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে!

আজ, ২৮শে জুলাই, বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হেপাটাইটিসকে নির্মূল করার জন্য সব দেশকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। লিভারের এই প্রদাহজনিত রোগ, যা হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ভাইরাসের মাধ্যমে ঘটে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ। বর্ষার এই সময়ে ডেঙ্গু এবং করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি হেপাটাইটিস রোগের প্রাদুর্ভাবও ঘটে থাকে, তাই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।

হেপাটাইটিস: এক নীরব ঘাতক যা ছোঁয়াচে নয়

হেপাটাইটিস মূলত লিভারের একটি প্রদাহ। দূষিত জল ও খাবারের মাধ্যমে হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় শরীরে কোনো উপসর্গ প্রকাশ না করলেও, ধীরে ধীরে এটি মারাত্মক রূপ ধারণ করে এবং লিভারের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে শুরু করে। এটি জেনে রাখা ভালো যে, হেপাটাইটিস রোগটি ছোঁয়াচে নয়।

শরীরে রোগের বিস্তার না ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট লক্ষণ ধরা পড়ে না। তবে দীর্ঘদিন শরীরে হেপাটাইটিস বাসা বাঁধলে যখন তা লিভারে আক্রমণ করে, তখন নানা লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। যেমন: শরীর দুর্বল লাগা, বমি বমি ভাব, পেটব্যথা, শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করা এবং হলুদ প্রস্রাবের মতো উপসর্গ। শরীরে এই রোগের বিস্তার ঘটলে পেটে জল আসা (অ্যাসাইটিস), রক্ত পায়খানা ও রক্তবমি পর্যন্ত হতে পারে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ধরন ও তার লক্ষণসমূহ:

হেপাটাইটিসের ৫টি প্রধান ভাইরাস হলো এ, বি, সি, ডি এবং ই। এর মধ্যে টাইপ-বি এবং সি সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নেয় এবং লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী আকার ধারণ করে। প্রাথমিক অবস্থায় এদের চিকিৎসা না করলে লিভার সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

১. হেপাটাইটিস এ: এই ভাইরাস দূষিত খাবার এবং জলের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস ‘এ’ এর ক্ষেত্রে লিভার ফুলে যাওয়া, খিদে কমে যাওয়া, জ্বর, বমি এবং জয়েন্টে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এই লক্ষণগুলো দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

২. হেপাটাইটিস বি: এটি রক্ত, ঘাম, লালা, বীর্যসহ বিভিন্ন দেহনিঃসৃত তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত রক্তে অবস্থিত ভাইরাস এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থিত অ্যান্টিবডি থেকে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস লিভারে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এর কারণে রোগীর বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, কোলিক (তীব্র পেটে ব্যথা), এবং ত্বকের হলুদ রঙের (জন্ডিস) মতো সমস্যা দেখা দেয়। এটি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগ যা লিভার সিরোসিস এবং ক্যানসারের রূপ নিতে পারে। যদি কোনো গর্ভবতী নারী এতে আক্রান্ত হন, তবে তার গর্ভস্থ শিশুও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৩. হেপাটাইটিস সি: হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘বি’ এর চেয়েও বেশি বিপজ্জনক এই ভাইরাসটি। রক্ত দেওয়া-নেওয়া, শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের সময় যদি জীবাণুযুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকে হেপাটাইটিস ‘সি’ এর সংক্রমণ হয়। পৃথিবীজুড়ে আনুমানিক ১৩০-১৭০ মিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস ‘সি’ রোগে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ‘সি’ আক্রান্ত ব্যক্তির তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না, তবে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ফলে লিভারের ক্ষত এবং বেশ কয়েক বছর পর সিরোসিস সৃষ্টি করে। অনেক সময় সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার অকার্যকর হয়ে যায়, যকৃতের ক্যানসার, বা খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর শিরা স্ফীত হতে পারে, যার ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও ত্বকে চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।

৪. হেপাটাইটিস ডি: হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ রোগীদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এটি দূষিত রক্তের সংক্রমণ, সংক্রামিত সূঁচ ব্যবহার বা শেভিংয়ের অন্যান্য কিটগুলির ব্যবহারের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। লিভারের সংক্রমণের ফলে বমি ও হালকা জ্বর হয়।

৫. হেপাটাইটিস ই: এই ভাইরাস দূষিত খাবার দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগী ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, ত্বকের হলুদ হওয়া এবং হালকা জ্বর অনুভব করে। হেপাটাইটিস ‘ই’ সংক্রমণের ফলে রোগীর ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, ফ্যাকাশে ত্বক ও চেহারা এবং জ্বরের মতো লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ধরন ও লক্ষণ যদি আপনার শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। সচেতনতা এবং সময় মতো চিকিৎসা এই নীরব ঘাতক থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy