যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডস সংক্রান্ত ‘ট্যাবু’ আজও সমাজের গভীরে প্রোথিত। একুশ শতকেও যখন নারী-পুরুষের সমতার স্লোগান ওঠে, তখনো বহু বাড়িতে ঋতুমতী নারীকে রান্নাঘর বা পুজোর দোরগোড়া থেকে দূরে রাখা হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে অভিনেত্রী-নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করের স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড সংক্রান্ত ব্যক্তিগত মন্তব্য সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যা নিয়ে দুই মেরুতে বিভক্ত টলিপাড়ার পরিচিত মুখেরা।
মমতা শঙ্করের মন্তব্য: ‘লজ্জার’ বিষয়?
পদ্মশ্রী মমতা শঙ্কর সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে, ঋতুমতীর সময়ে ছেলে বা বাবাকে স্যানিটারি প্যাড আনতে বলাটা তাঁর কাছে ‘লজ্জার’। এই মন্তব্য সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা হলেও, তা সমাজে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত উঠে আসছে।
মানসী সিনহা: ট্যাবু-মুক্ত পরিবেশে বিশ্বাসী
অভিনেত্রী-পরিচালক মানসী সিনহা মমতা শঙ্করের এই ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। ইটিভি ভারতকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট জানান, “আমার মতে উনি যা বলেছেন তা আমি বিশ্বাস করি না, মানিও না।” তবে, একই সঙ্গে তিনি মমতা শঙ্করকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করার তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, “উনি একজন সিনিয়র মানুষ।”
নিজের যমজ ছেলে-মেয়ের উদাহরণ দিয়ে মানসী সিনহা বলেন, তিনি বাড়িতে এমন পরিবেশ তৈরি করেছেন যেখানে কোনো রকম ‘সামাজিক ট্যাবু’র স্থান নেই। তাঁর কথায়, “আমার ছেলে যখন মান্থলি শপিং করতে যায় তখন আমার মেয়ে বৃষ্টি স্যানিটারি ন্যাপকিনও কিনে নিয়ে আসে।” তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, “ওরা যখন একসঙ্গে খেলে তখন বৃষ্টির যদি পিরিয়ডস চলে, আমার ছেলেই বন্ধুদের বলে, বৃষ্টিতে বেশি যাতে দৌড়াদৌড়ি না করানো হয়। ওর শরীর ভালো নেই। আসলে আমার বাড়িতে এই সব নেই। আমি ছোট থেকেই ছেলেকে শিখিয়েছি, বোনের দায়িত্ব তোমার। আর দায়িত্ব মানে সবদিকের দায়িত্ব। তার মধ্যে এটাও পড়ে।”
মেয়েদের উদ্দেশ্যে মানসী বলেন, “এটা তোমার কাছে সম্মানের। তোমার পিরিয়ডস হচ্ছে মানে তুমি মা হওয়ার উপযুক্ত। এটা লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়, স্বাভাবিক। এটা ভীষণ গর্বের বিষয় একটা মেয়ের কাছে।” মমতা শঙ্কর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মমতা শঙ্করদি পুরনো দিনের মানুষ। উনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে পাল্টাতে পারেননি। পাল্টানো মানে ভুলগুলি মেনে নেওয়া নয়।”
পোশাক প্রসঙ্গেও মানসী সিনহা তাঁর মত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “এই যে মেয়েরা ছোট ছোট জামা কাপড় পরে নিজেদের এক্সপোজ করে, এটা যে সবসময় সর্ব ক্ষেত্রে আমারও যে ভালো লাগে তা কিন্তু নয়। …কিন্তু এটা নিয়ে যদি কেউ বলেন, ছোট পোশাক পরা মেয়েদের দেখে ছেলেদের অন্য মেয়েদের ধর্ষণ করার প্রবণতা বাড়ে তা হলে কি ধরে নিতে হয় যবে থেকে এদেশে ছোট জামা ঢোকেনি তার আগে দেশে কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হননি! এটা হয় কখনও?”
মৌসুমী ভট্টাচার্যের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও যুক্তি
অন্যদিকে, অভিনেত্রী মৌসুমী ভট্টাচার্য মমতা শঙ্করের পক্ষে একটি ভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। ইটিভি ভারতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি সম্মানীয় অভিনেত্রী-নৃত্যশিল্পীকে কটাক্ষ না করে যুক্তি দিয়ে ভাবতে বলেছেন। মৌসুমী প্রশ্ন তোলেন, “যদি না কোনো এমারজেন্সি হয় তাহলে একজন মা দুম করে ১২-১৩ বছরের ছেলেকে বা ১৮ বছরের ছেলেকে বলতে পারবে ‘তুই আমার স্যানিটারি প্যাডটা এনে দে’? পারবে কি? একজন ২৩-২৫ বছরের মহিলা বা ৩০ বছরের মহিলা দুম করে বয়স্ক বাবাকে কি বলতে পারবে স্যানিটারি প্যাড কেনার কথা?”
মৌসুমীর মতে, “ছোট থেকে আমরা এই বিষয়ে মা-দিদিকে বলেই অভ্যস্ত। ওই কালচারেই মানুষ হয়েছি। সেইদিক থেকে দাঁড়িয়ে কোনো মানুষ যদি ভোকাল হয় তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?” তিনি আরও বলেন, “আজকে একটা ছেলে যদি তাঁর স্ত্রী বা বান্ধবীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গঠন করতে চায় তাহলে সে কি তাঁর বাবা-মাকে বলতে পারবে, কন্ডোমটা কিনে এনে দাও! পারবে কি? …এমারজেন্সিতে (মেয়েরা) ভাইকে বা দাদাকে বা বাবাকে বলতে পারবে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে এনে দেওয়ার কথা। বা কাগজে লিখে দিল। কিন্তু একটা ছেলের সেই সাহস থাকবে কি বাবাকে কন্ডোমের প্যাকেট কিনে এনে দিতে বলবে?”
মৌসুমী ভট্টাচার্য মমতা শঙ্করের কথাকে সম্পূর্ণ সমর্থন না করলেও বলেন, “যদি এই ভাবে ভাবি তাহলে উনি খুব একটা ভুল কিছু বলেননি। যতই আমরা মডার্ন হয়ে যাই না কেন বাঙালি সংস্কৃতি, শিক্ষায় মেয়েদের এইটুকু লজ্জা তো রাখতে হবে। ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়ানো মডার্ন নয়। এই আধুনিক হওয়ার চক্করে মানুষ শিক্ষাটা ভুলে যাচ্ছে। জানার কোনো ইচ্ছা নেই। কেন মমতা শঙ্কর এমনটা বলেছেন তা নিয়ে ভাবার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। তাঁর শিক্ষা নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা আছে কারোর? …মমতা শঙ্করদি বুদ্ধিহীন, অশিক্ষিত বোকা মহিলা কিন্তু নন। উনি যে কথা গুলো বলে ভীষণ ভেবেচিন্তেই বলেন। এই ধরনের সংস্কৃতি দেখে বিরক্ত হয়ে বলেন।”
এই বিতর্কের রেশ যে আরও কিছুদিন চলবে, তা বলাই বাহুল্য। একদিকে যেমন প্রগতিশীল চিন্তাধারার advocatesরা পুরনো ট্যাবু ভাঙতে চাইছেন, অন্যদিকে অনেকেই পরম্পরা ও সামাজিক শালীনতার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন।