শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে রথযাত্রা উৎসব পুরীর বিশ্বজুড়ে পরিচিত, এবার সেই একই রথের চাকা গড়াতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন কেন্দ্র দিঘার সমুদ্র সৈকতে। পুরী থেকে মাত্র সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে এই প্রথম মহাধূমধাম করে রথযাত্রা পালিত হতে চলেছে, যার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, দিঘা কি পারবে পুরীর সেই ঐতিহ্য, ভক্তি আর রীতিকে ধারণ করতে? নাকি এটি কেবল ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’র মতো হবে? পুরী ও দিঘার রথযাত্রার মধ্যে ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে, তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।
দিঘার জগন্নাথ মন্দির ঘিরে বিতর্ক: অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই দিঘার এই জগন্নাথ মন্দির পুরীর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে মন্দিরের উদ্বোধনলগ্ন থেকেই এটি ‘জগন্নাথ ধাম’ নাম বিতর্ক, সরকারি টাকায় নির্মাণ, প্রসাদ বিলি এবং এমনকি ‘নিমকাঠ চুরির’ মতো অভিযোগের কারণে সমালোচিত। একদিকে যখন দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ বাংলার মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পুরীর প্রসাদ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। দিঘার জগন্নাথ মন্দির নিয়ে রাজ্য রাজনীতি রীতিমতো সরগরম, এবং এটিকে ‘ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন শুভেন্দু।
পুরীর রথযাত্রা – এক অদম্য ঐতিহ্য: অন্যদিকে, পুরীর রথযাত্রা ‘নবদিন যাত্রা’, ‘দশাবতার যাত্রা’ এবং ‘গুন্ডিচা যাত্রা’ নামেও পরিচিত। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ‘ভগবান জগন্নাথ’ নামে পূজিত হন। ওড়িয়া পঞ্জিকা অনুসারে আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত এই উৎসবের টানে প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্ত ছুটে আসেন।
পুরী ও দিঘার রথযাত্রার মূল পার্থক্য:
১. রীতি ও মন্ত্রোচ্চারণ: ইসকন কলকাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাস bangla.aajtak.in-কে জানিয়েছেন, একই দিনে উৎসব পালন করা হলেও রথযাত্রার বিধি সম্পূর্ণ আলাদা। দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে বৈষ্ণব ধর্মের রীতি মেনে উৎসব পালন করা হবে, যেখানে পুরীতে হিন্দু ঐতিহ্য এবং শংকরাচার্যের নিয়ম অনুযায়ী রথযাত্রার রীতি পালিত হয়। দিঘাতে রথযাত্রার মন্ত্রোচ্চারণও পুরীর থেকে ভিন্ন হবে।
২. প্রবেশাধিকার ও জাতপাত: এটি একটি বড় পার্থক্য। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি, ইসকন সদস্যদের মধ্যে যারা নব-ধর্মান্তরিত বা ঐতিহ্যবাহী হিন্দু নন, তাদের প্রবেশাধিকার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এর বিপরীতে, দিঘার মন্দিরের দেখভালের দায়িত্ব ইসকনের কাছে থাকায় এখানে জাতপাতের কোনো ব্যাপার নেই। জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভক্ত এখানে পূজা দিতে পারবেন এবং রথযাত্রার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন, যা দিঘার রথযাত্রাকে একটি সর্বজনীন রূপ দিচ্ছে।
৩. বিগ্রহ ও মাসির বাড়ি: পুরীর মতোই দিঘাতে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা তিনটি পৃথক রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন। তিনটি সুবিশাল রথও মন্দির চত্বরে তৈরি করা হয়েছে। তবে, পুরীতে দারুব্রহ্ম বিগ্রহ রথে চড়ে মাসির বাড়ি গেলেও, দিঘা জগন্নাথ ধামে পাথরের বিগ্রহ স্থায়ীভাবে থাকবে।
৪. রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও প্রস্তুতি: দিঘায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি স্বয়ং সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথ যে পথে যাবে, সেই রাস্তা ঝাঁট দেবেন। প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা খরচ করে দিঘা থানা সংলগ্ন পুরনো জগন্নাথ মন্দিরকে মাসির বাড়ি হিসেবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।
এই সব পার্থক্যগুলি দিঘার রথযাত্রাকে পুরীর থেকে আলাদা এক পরিচয় দিচ্ছে। দিঘা কি নিজস্ব একটি ‘রথ সংস্কৃতি’ গড়ে তুলতে পারবে, নাকি পুরীর ঐতিহ্যের ছায়া হয়েই থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে। সমস্ত নজর এখন এই নতুন রথযাত্রার দিকে।