বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এবার সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়াচ্ছে উদ্বেগ

এক নতুন এবং গভীর উদ্বেগের মেঘ ঘনাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আকাশে। আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (ICG) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের একটি অংশ এখন মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (AA) বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছে। কক্সবাজার ও টেকনাফের শরণার্থী শিবির থেকে কিছু রোহিঙ্গা যুবক রাখাইন রাজ্যে হামলা চালাচ্ছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক প্রশিক্ষণ চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে ICG। সংস্থাটি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য এক বিপজ্জনক মোড় তৈরি করতে পারে।

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে প্রায় ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার ও টেকনাফের শিবিরে আশ্রয় নিয়ে আছে। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করার পর, রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই চরম পরিস্থিতিতেই কিছু রোহিঙ্গা যুবক পুনরায় অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ICG-এর মতে, বছরের পর বছর ধরে ক্যাম্পে চলা রক্তাক্ত আন্তঃদলীয় সংঘাতের পর, রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী এই গোষ্ঠীগুলি গত নভেম্বরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে ক্যাম্পে সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, কিন্তু একই সাথে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংগ্রহ বেড়েছে।

ICG-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নতুন সশস্ত্র তৎপরতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে। বাংলাদেশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজভূমে ফেরত পাঠানো। কিন্তু রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় প্রত্যাবাসনের সেই প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।

ICG আরও জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমানকে এ বিষয়ে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। তবে, এই আলোচনার উদ্যোগ দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক চাপ এবং সামরিক নেতৃত্বের আপত্তির মুখে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার ‘মানবিক করিডোর’ প্রস্তাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র হওয়া এবং আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে তাদের লড়াই শুধু রাখাইন রাজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে আরও জটিল করবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। ICG সতর্ক করেছে যে, রোহিঙ্গাদের এই সশস্ত্র বিদ্রোহ মিয়ানমারে তাদের প্রতি জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে এবং নাগরিকত্ব সহ পূর্ণ অধিকারের জন্য তাদের আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে এক কঠিন কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। একদিকে মানবিক দায়িত্ব, অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা – এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা এবং একইসাথে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা বাংলাদেশের জন্য এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপের দাবি রাখে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy