কাশ্মীর উপত্যকার ইতিহাস কেবল যুদ্ধজয়ের গল্প নয়, বরং এটি ধর্ম ও রাজনীতির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। সম্প্রতি বারামুল্লার জেহানপুরায় খননকার্যের ফলে কুষাণ যুগের স্তূপের আবিষ্কার পুনরায় বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, একসময় কাশ্মীর ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু ইতিহাসের এক নাটকীয় মোড়ে, এক বৌদ্ধ রাজপুত্রের হাত ধরেই এই উপত্যকায় ইসলামী শাসনের বীজ বপন করা হয়েছিল।
পৌরাণিক কাহিনি ও কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ অনুসারে, কাশ্মীর একসময় ছিল ‘সতীসর’ নামক এক বিশাল হ্রদ। ঋষি কাশ্যপের তপস্যায় পাহাড় কেটে জল বের করে দেওয়ার পর সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোক এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটান এবং শ্রীনগর প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের আমলে চতুর্থ বৌদ্ধ সংঘ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অষ্টম শতকে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের শাসনামলে মার্তণ্ড সূর্যমন্দির নির্মাণের মাধ্যমে কাশ্মীরি স্থাপত্য ও সংস্কৃতি শিখরে পৌঁছায়।
তবে চতুর্দশ শতকের শুরুতে কাশ্মীরের পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং ‘দামর’ নামক জমিদার শ্রেণির ষড়যন্ত্রে রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময়েই তিন আগন্তুক কাশ্মীরে আশ্রয় নেন— সোয়াতের শাহ মীর, দার্দ অঞ্চলের লঙ্কর চক এবং লাদাখের বৌদ্ধ রাজপুত্র রিঞ্চন। ১৩২০ সালে মঙ্গোল সেনাপতি দুলুচার নৃশংস আক্রমণের সুযোগ নিয়ে রিঞ্চন ক্ষমতা দখল করেন। নিজের শাসনকে বৈধতা দিতে তিনি কাশ্মীরের শেষ হিন্দু রানি, কোটা রানিকে বিবাহ করেন।
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আসে তখন, যখন রিঞ্চন হিন্দু (শৈব) ধর্ম গ্রহণ করতে চান। কিন্তু তৎকালীন প্রধান পুরোহিত দেবস্বামী তাঁর জাতিগত পরিচয়কে কেন্দ্র করে তাঁকে শৈব ধর্মে দীক্ষিত করতে অস্বীকার করেন। এই প্রত্যাখ্যানই রিঞ্চনকে সুফি সাধক বুলবুল শাহের দিকে ঠেলে দেয়। রিঞ্চন ইসলাম গ্রহণ করে নাম নেন ‘সুলতান সদরুদ্দিন’—তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক। মাত্র তিন বছরের রাজত্বের পর তাঁর মৃত্যু হলেও, তাঁর হাত ধরেই শাহ মীর বংশের পথ প্রশস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে কাশ্মীর এক বৌদ্ধ-হিন্দু কেন্দ্র থেকে ইসলামী শাসনের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়।