নয়াদিল্লিতে পুতিনের পা, UK, ফ্রান্স, জার্মানির যৌথ হামলা—ইউরোপ কেন ভারতের ভারসাম্যে এত উদ্বিগ্ন?

নয়াদিল্লি: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ৪ ডিসেম্বর ভারত সফরকে কেন্দ্র করে এক গুরুতর কূটনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে, যা ইউরোপের উদ্বেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পুতিন দু’দিনের সফরে নয়াদিল্লি পৌঁছানোর আগেই, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির রাষ্ট্রদূতরা একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে যৌথ সম্পাদকীয় লিখে ইউক্রেন যুদ্ধ বাড়ানোর জন্য সরাসরি পুতিনের উপর দোষারোপ করেন। ওই লেখায় তারা শান্তি স্থাপনে রাশিয়ার অনীহা এবং এমনকি যুদ্ধাপরাধের ইঙ্গিতও দেন।

এই যৌথ প্রবন্ধ প্রকাশের পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রক (MEA) এটিকে “অগ্রহণযোগ্য এবং অস্বাভাবিক” বলে অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র চাপের মুখে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ভারতের এই দৃঢ় অবস্থান তার স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টান্ত।

কেন ইউরোপ এত উদ্বিগ্ন?

পুতিনের ভারত সফর ইউরোপে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে তার কারণ, ইউরোপের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাঝখানে মস্কোর উপস্থিতি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারে।

ইউরোপ-ভারতের মেগা চুক্তিগুলির উপর ছায়া

ইউরোপ বর্তমানে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে মজবুত করতে চাইছে:

  • ইউকে-ভারত FTA: ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ভারত ও ইউকে একটি ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্বাক্ষর করে। আশা করা হচ্ছে, এটি ২০৪০ সালের মধ্যে ইউকে-এর অর্থনীতিতে প্রায় £১৫.৭ বিলিয়ন যোগ করবে।

  • ফ্রান্সের সাথে প্রতিরক্ষা জোট: ২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য ২৬টি রাফাল এম যুদ্ধবিমান কেনার লক্ষ্যে ৬৩,০০০ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর পাশাপাশি আরও ১১৪টি রাফাল জেট নিয়ে আলোচনা চলছে, যা ভারত-ফ্রান্স প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে দৃঢ় করছে।

  • জার্মানির অর্থনৈতিক লক্ষ্য: জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে FTA চূড়ান্ত করতে আগ্রহী, যার লক্ষ্য ২০২৫ সালের শেষের মধ্যে চুক্তিটি সম্পূর্ণ করা। ২০২৪ সালে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৩১ বিলিয়ন ইউরো ছুঁয়েছে।

ইউরোপ মনে করছে, ভারত যখন মস্কো এবং ইউরোপীয় রাজধানীগুলির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে, ঠিক তখনই পুতিনের এই সফর তাদের এই নতুন অংশীদারিত্বের উপর একটি ছায়া ফেলছে।

ইউক্রেন সংঘাতের সরাসরি অর্থনৈতিক প্রভাব

ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কেন্দ্র পোকরোভস্ক রুশ হামলায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ায় ইউরোপের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এই বন্দরের ক্ষতি ইউরোপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট বন্ধ করে দিয়েছে, যা ইউরোপীয় বাণিজ্য শৃঙ্খলে সরাসরি অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

রুবল-রুপি বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ

ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও ভারত-রাশিয়া বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমশ বাড়ছে, যা বর্তমানে ৬৮.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে রাশিয়া ভারতের সঙ্গে Special Rupee Vostro Account (SRVA)-এর মাধ্যমে রুপিতে বাণিজ্য করছে। ফলে রাশিয়ার কাছে বিশাল অঙ্কের ভারতীয় রুপি জমা হয়েছে। ৪ ডিসেম্বরের আলোচনায় প্রতিরক্ষা ও জ্বালানির পাশাপাশি সেই রুপি তারা ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য, পোশাক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

বিকল্প বাণিজ্য পথের উত্থান

২০২৫ সালের আগস্টে পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে বৈঠকের পর রাশিয়ার জন্য আলাস্কা বাণিজ্য করিডোর খুলে দেওয়া হয়েছে। এই করিডোরটি ইউরোপের বাণিজ্য নেটওয়ার্কগুলির সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা তৈরি করছে, যা ইউরেশিয়ায় ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

ভারতের স্বাধীন কূটনীতি

চীন-রাশিয়া-ভারতের সম্ভাব্য জোট নিয়ে ইউরোপের আশঙ্কা থাকলেও, ভারত তার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বজায় রেখেছে। ভারত কোনো এক পক্ষের সঙ্গে একচেটিয়াভাবে জোট বাঁধতে অস্বীকার করেছে। বরং, শক্তি, প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তির জন্য পশ্চিমা দেশ, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলার ভারতের এই বাস্তববাদী কূটনীতি ইউরোপের কূটনৈতিক লক্ষ্যগুলিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ভারত বৈশ্বিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় সফল হয়েছে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy