৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) আজ থেকে তাদের তিন দিনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রানীতি কমিটির (MPC) বৈঠকে বসছে। অক্টোবর মাসে খুচরো মূল্যস্ফীতি (Inflation) ঐতিহাসিক ভাবে মাত্র ০.২৫ শতাংশে নেমে আসায়, সুদের হার কমানো নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে রেকর্ড-ভাঙা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি তলানিতে—এই বিপরীতমুখী পরিস্থিতিতে RBI কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিকেই তাকিয়ে আছে গোটা দেশ।
💰 মূল্যস্ফীতি তলানিতে, অর্থনীতিতে জোয়ার
ভারতের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে এক বৈপরীত্যের ছবি তুলে ধরছে।
-
রেকর্ড জিডিপি: চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (Q2 FY26) ভারতের অর্থনীতি ৮.২ শতাংশ জিডিপি (GDP) বৃদ্ধি নথিভুক্ত করেছে, যা গত ছয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বোচ্চ। শক্তিশালী উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্র এবং ৭.৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ভোগ বৃদ্ধির জোরে এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
-
ঐতিহাসিক মূল্যহ্রাস: এই বিশাল বৃদ্ধির বিপরীতে খুচরো মূল্যস্ফীতি (Consumer Price Index বা CPI দ্বারা পরিমাপ করা হয়) অক্টোবর ২০২৫-এ নেমে এসেছে মাত্র ০.২৫ শতাংশে। ২০১২ সালে সিরিজটি শুরু হওয়ার পর এটিই সর্বনিম্ন এবং RBI-এর ২-৬ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক নীচে।
-
মূল কারণ: খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে কমে যাওয়াই এই মূল্যস্ফীতি হ্রাসের প্রধান কারণ। যদিও ভোক্তারা এতে স্বস্তি পাচ্ছেন, কিন্তু অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন যে দীর্ঘস্থায়ী ডিফ্লেশনারি চাপ গ্রামীণ আয় এবং সামগ্রিক চাহিদার ক্ষতি করতে পারে।
🤔 বিশেষজ্ঞদের মতামত: এখনই সুদ কমানো উচিত কি?
MPC-এর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বাজার বিশ্লেষকরা বিভক্ত। যদিও একটি বড় অংশ ‘সতর্ক-ডোভিশ’ (Cautious-Dovish) অবস্থানের পক্ষে।
-
বিপক্ষে মত (শীঘ্র কমানো উচিত নয়): এসএস ওয়েলথস্ট্রিটের প্রতিষ্ঠাতা সুগন্ধা সচদেব মনে করেন, কম মূল্যস্ফীতি এবং শক্তিশালী বৃদ্ধির কারণে RBI-এর হাতে রেট কমানোর সুযোগ থাকলেও, অর্থনীতির জোরালো গতির কারণে এখনই তা জরুরি নয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, “অকালপক্ক সুদের হার হ্রাস একটি ইতিমধ্যে তেজি অর্থনীতিকে অতিরিক্ত উদ্দীপিত করার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।” তিনি আপাতত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে, তবে শেষ প্রান্তিকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট (bps) কমানোর পথ খোলা রাখতে বলেছেন।
-
পক্ষে মত (অবিলম্বে কমানো উচিত): নাইট ফ্রাঙ্ক ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শিশির বাইজাল আরও দ্রুত পদক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি মনে করেন, অর্থনীতি বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে রয়েছে, যেখানে মুদ্রানীতির পদক্ষেপ ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে’। তাঁর মতে, ২৫ বেসিস পয়েন্ট রেপো রেট কমালে তা ‘ক্রয় ক্ষমতা আরও বাড়াবে এবং গৃহঋণের হার, বিশেষ করে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনগুলির জন্য উন্নত করবে।’
-
সাবধানী দৃষ্টিভঙ্গি: দ্য ওয়েলথ কোম্পানি মিউচুয়াল ফান্ডের সিআইও-ডেব্ট উমেশ শর্মা ডিসেম্বরে হার কমানোর সম্ভাবনাকে ‘ট্রিকি’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে বৈশ্বিক পরিস্থিতি মিশ্র থাকার কারণে আরও সুদের হার কমানোর প্রভাব সীমিত হতে পারে। তাঁর পরামর্শ, RBI-এর উচিত একটি ‘সুদৃঢ় ডোভিশ টোন বজায় রাখা, যেখানে আরও মুদ্রাসংক্রান্ত স্থান (Monetary Accommodation)-এর উপর জোর দেওয়া হবে।’
📉 অন্যান্য উদ্বেগ: ৯০ পার করল রুপি!
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে অন্য দুটি কারণে। ১. রেকর্ড-পতন: ভারতীয় মুদ্রা প্রথমবারের মতো প্রতি ডলারে ৯০ টাকা-র মাইলফলক অতিক্রম করে সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। ২. বেকারত্ব বৃদ্ধি: একই সঙ্গে, উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির তথ্য দেখায় যে সাপ্তাহিক বেকারত্বের হার বেড়ে ৫.১-৫.২ শতাংশ-এর মধ্যে পৌঁছেছে। এটি শিরোনামে থাকা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্যে সম্ভাব্য অসঙ্গতির বিষয়টি তুলে ধরছে।
🛣️ MPC-এর অতীতের পথ
২০২৫ সালের শুরুতেই RBI মূল্যস্ফীতি কমার প্রতিক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে রেপো রেট ৬.৫% থেকে ৫.৫% পর্যন্ত মোট ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছিল। তবে শেষ বৈঠকে কমিটি ‘নিরপেক্ষ’ (Neutral) অবস্থান বজায় রেখে বিরতি নিয়েছিল।
এখন, বছরের শেষ বৈঠকে, কমিটি কি ফের সুদের হার কমানোর চক্র শুরু করবে, নাকি পরস্পর বিরোধী অর্থনৈতিক সংকেতের মুখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে – সেটাই দেখার বিষয়।