মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের উত্তর রামপুর গ্রামে দেখা গেল এক হৃদয় বিদারক অথচ মানবিকতার অনন্য নজির। সরকারি খাসজমির দখলদারি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদের জেরে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা যখন ৬৫ বছর বয়সী হিন্দু বৃদ্ধ রণজিৎ দাস ওরফে টুপন-এর দেহ সৎকার করতে এগিয়ে এলেন না, তখন পাশের মুসলমান পাড়ার লোকজনই এসে সেই শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করলেন।
জমি বিবাদ ও একঘরে করে রাখার অভিযোগ: মৃত রণজিৎ দাস খাসজমিতে ঘর বেঁধে পরিবার প্রতিপালন করতেন। তাঁর বাড়ির সামনের খাসজমি দখল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পড়শিদের সঙ্গে বিবাদ চলছিল।
-
বিবাদের কারণ: টুপনের ছেলে কিশোর দাস অভিযোগ করেন, প্রতিবেশীরা জমি দখল করতে দু’বছর আগে সেখানে অস্থায়ী মন্দির তৈরি করে সরস্বতী প্রতিমা রেখে দেন, যা নিয়ে বারবার ঝামেলা হয়েছে।
-
নেতাদের মদতের অভিযোগ: মৃত বৃদ্ধের স্ত্রী কলাবতী দাস এবং ছেলে কিশোরের অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য প্রকাশ দাস এবং প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান রেজাউল হক প্রতিবেশীদের মদত দিচ্ছেন। তাঁদের নির্দেশেই প্রতিবেশীরা টুপনের পরিবারকে একঘরে করে রেখেছিলেন। কিশোর দাস (সিভিক ভলান্টিয়ার হওয়া সত্ত্বেও) অভিযোগ জানানোর পর পুলিশ কোনও কাজ করেনি।
-
মৃত্যুর কারণ: জমি নিয়ে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের জেরেই টুপন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মঙ্গলবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।
মুসলমান ভাইদের কাঁধে শেষযাত্রা: টুপনরা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী, তাই ধর্মীয় আচার অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁদের কবর দেওয়া হয়। প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে না আসায় যখন স্ত্রী ও ছেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন এই খবর পৌঁছয় পাশের মুসলমান পাড়ায়।
মুসলমান পাড়ার বাসিন্দা মান্নান আলি বলেন, “মঙ্গলবার সকালে শুনি সিভিক ভলান্টিয়ারের বাবা টুপন দাস মারা গিয়েছেন। পরে শুনি, ওদের সমাজের কেউ মৃতদেহের কাছে ভিড়ছে না। তখন আমরাই কাঁধে করে মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাই এবং মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করি। জমি নিয়ে গণ্ডগোল থাকতেই পারে, কিন্তু মৃত্যুর পরেও পাশে না থাকাটা অমানবিকতার পরিচয়। আমরা সবসময় চাই, আমরা হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই হয়েই থাকব।”
অভিযুক্ত নেতার অস্বীকার ও প্রশাসনের তৎপরতা: যদিও অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা প্রকাশ দাস তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, তিনি কোনও কাজে বাধা দেননি এবং তাঁকে বদনাম করার চক্রান্ত চলছে।
তবে এই ঘটনায় হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের বিডিও সৌমেন মণ্ডল এবং স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নীহাররঞ্জন ঘোষ উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিধায়ক বলেন, “এমন ঘটনা কখনই কাম্য নয়। এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতা।” তিনি প্রশাসনকে কঠোর হাতে বিষয়টি দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। জেলার এক পুলিশকর্তা জানিয়েছেন, খাসজমির দখলদারি নিয়ে অভিযোগের তদন্ত চলছে এবং একঘরে করে রাখার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।