দিঘা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এগরার পাঁচরোল গ্রামে লুকিয়ে আছে বাংলার বৈষ্ণব ঐতিহ্যের এক বিরল অধ্যায়—ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ মন্দির। জরাজীর্ণ দালান, খসে পড়া পলেস্তরা এবং চারপাশের প্রাচীন টেরাকোটার কাজ আজও মনে করিয়ে দেয় অষ্টাদশ শতাব্দীর এক বিস্মৃত স্থাপত্যের কথা।
এই প্রাচীন মন্দিরের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এর বিগ্রহ। একটিমাত্র কাষ্ঠখণ্ডে নির্মিত এই বিগ্রহে কৃষ্ণ, বলরাম এবং চৈতন্যদেবের সম্মিলিত ‘ষড়বাহু’ রূপের প্রতিফলন ঘটেছে। এটি চৈতন্যদেবের প্রকাশিত সেই কিংবদন্তি ‘ষড়ভূজ রূপ’কে ধারণ করে, যেখানে উপরের দুই হাতে রামের ধনুক-বাণ, মাঝের দুই হাতে কৃষ্ণের বাঁশি, আর নিচের দুই হাতে বলরামের গদা-কমণ্ডলু—এই মিলিত প্রতিমারূপ বাংলার বৈষ্ণব শিল্পকলার এক দুর্লভ নিদর্শন।
রাজপুতানা থেকে জমিদারী প্রতিষ্ঠা
মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস। এর প্রতিষ্ঠাতা পরিবার মূলত রাজপুতানার শোলাঙ্কি বংশের—যারা আলাউদ্দিন খিলজির আমলে সংঘর্ষের ফলে দেশান্তরী হন। পুরীর কাছে আশ্রয় নিয়ে তাঁরা নিজেদের রাজপুত পরিচয় লুকিয়ে ‘রাজু’ জাতিতে রূপান্তরিত করে ‘দাস মহাপাত্র’ পদবি গ্রহণ করেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই বংশের নারায়ণ দাস মহাপাত্র পুরী থেকে এসে এগরার পাঁচরোল গ্রামে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। চম্পা নদীর বাণিজ্যপথকে কাজে লাগিয়ে তিনি ধান-চালের ব্যবসা শুরু করেন এবং ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’-এর সময় বিপুল সম্পদের মালিক হন। নবাব দরবার থেকে জমিদারী প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেয়ে তাঁর উদ্যোগেই গড়ে ওঠে পাঁচরোলগড়।
পরবর্তী প্রজন্মে, এই বংশের ষষ্ঠ পুরুষ চৌধুরী কৃষ্ণগোবিন্দ দাস মহাপাত্র বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়ে মদনমোহন মন্দির এবং ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ মন্দির নির্মাণ করেন।
টেরাকোটা ফলকে সময়ের আঘাত
প্রায় ৩৭ ফুটের বেশি উচ্চতার এই দালান-শৈলীর মন্দিরের স্থাপত্যও অনন্য। রয়েছে চারদিকে প্রশস্ত অলিন্দ, ১৩টি প্রবেশদ্বার এবং সামনের বিশাল টেরাকোটার কাজ। বৈষ্ণব কীর্তন, মিথুন, অলংকার ও শিলালেখে ‘ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ’-এর উপস্থাপনা—সবই টেরাকোটার ফলকে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একসময় চূড়ায় ‘রত্ন’-রীতির শিখর ছিল, কিন্তু আজ কেবল লৌহদণ্ডটি পড়ে আছে। সিংহমূর্তি, ময়ূরের ভাস্কর্য এবং অলংকারের ফলক—সবই সময়ের আঘাতে ভেঙে পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংস্কারের অভাব ও উদাসীনতার কারণে এই ঐতিহাসিক সৌধটি ধীরে ধীরে তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে। দ্রুত সংরক্ষণ না হলে বাংলার অন্যতম মূল্যবান স্থাপত্য-ঐতিহ্য ইতিহাসের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।