পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে ডুলুং নদীর তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত কনকদুর্গা মন্দির। ৪৩৮ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের পুজো ঘিরে রয়েছে নানা মিথ এবং সামন্ত রাজাদের সাড়ে চারশো বছরের ইতিহাস। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে, এই ব্যতিক্রমী আড়ম্বরহীন পুজো উপলক্ষে প্রতি বছরই দর্শনার্থীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে থাকে মন্দির চত্বর।
দেবী এখানে ‘অশ্বারোহিণী’
এই মন্দিরে দেবী কনকদুর্গা হলেন অশ্বারোহিণী চতুর্ভূজা। অষ্টধাতুর এই মূর্তি ঘিরেই দুর্গাপূজা জমে ওঠে। ইতিহাস বলে, চিলকিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। একসময় গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিশা পুজোয় শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরা অংশ নিতেন। ২০০৭-২০০৮ সালে দু’বার মূর্তি চুরি যাওয়ার পরে বর্তমানে নতুন করে অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করা হয়েছে এবং মন্দিরে সিসিটিভি বসানো হয়েছে।
হাঁসের ডিম ও পান্তা ভাতের ভোগ
ঝাড়গ্রামের কনকদুর্গা মন্দিরের পুজোর নিয়মাবলী অনেকটাই ভিন্ন এবং ব্যতিক্রমী। এই চারদিন দেবীকে বিশেষ রীতি আচার মেনে ভোগ নিবেদন করা হয়:
- মহাষ্টমীতে দেবীকে হাঁসের ডিমের ভোগ দেওয়া হয়।
- পুজোর চারদিন দেবীর ভোগে থাকে মাছ পোড়া, শাক ভাজা এবং পান্তা ভাত।
- প্রতিবার খাবারের শেষে মায়ের জন্য একটি পান দিয়ে আসেন পুরোহিতরা।
নবমীর রহস্যময় ‘গোপন কক্ষ’
এই পুজোর আরও একটি বিশেষ এবং রহস্যময় রীতি হলো— অষ্টমীর পুজোর পর গভীর রাতে জঙ্গলের ভিতরের একটি কক্ষে নতুন মাটির হাঁড়িতে জল ও অন্যান্য সামগ্রী ভরে শালপাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে উনুনে চাপিয়ে দেন মন্দিরের মূল পুরোহিত। উনুনে তিনটি কাঠ জ্বেলে ঘরের দরজা তালা দিয়ে বন্ধ করে চাবি রাজবাড়িতে দিয়ে আসা হয়। সেই কক্ষে বাইরের কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। নবমীর দিন সকালে ফের রাজবাড়ি থেকে চাবি এনে দরজা খোলা হয়, এবং শুরু হয় নবমীর পুজো।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত এবং মায়ের কাছে প্রার্থনা করলে তা পূর্ণ হয়। এই বিশ্বাস থেকেই সারাবছরই পুণ্যার্থীরা এবং পুজোর সময় বহু পর্যটক এখানে ভিড় করেন।
মন্দির লাগোয়া বিশাল ভেষজের জঙ্গল পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রেও জায়গা করে নিয়েছে। পরিচর্যার অভাবে মূল্যবান ওষুধের গাছ নষ্ট হওয়া রুখতে বর্তমানে রক্ষী ও চেকপোস্ট তৈরি করা হয়েছে। ভগ্নপ্রায় চিলকিগড়ের রাজবাড়ি ও কনকদুর্গা মন্দিরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ডুলুং নদী।