গর্ভবতী মায়েদের জন্য ব্যায়ামের গাইডলাইন, সুস্থ মা, সুস্থ শিশুর নেপথ্যে কী কী করণীয়?

গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে এক বিশেষ অধ্যায়। এই সময়ে যেমন খাদ্যাভ্যাস জরুরি, তেমনই শারীরিক সুস্থতার জন্য ব্যায়ামের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তবে ফিটনেস বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, গর্ভবতী মায়েদের জন্য ব্যায়াম নির্ধারণ করতে হবে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী। তাঁদের কথায়, “গর্ভাবস্থায় কিছু ব্যায়াম উপকারী, আবার কিছু একেবারেই নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই সময় কোনো রকম শারীরিক চর্চা করা উচিত নয়।” এর মানে এই নয় যে হবু মায়েদের কেবল শুয়ে-বসেই দিন কাটাতে হবে। বরং, চিকিৎসকরা গর্ভাবস্থায় ব্যায়ামের গুরুত্ব তুলে ধরেন। আসুন, জেনে নেওয়া যাক কেন এই সময়ে ব্যায়াম জরুরি এবং কী ধরনের ব্যায়াম নিরাপদ।

কেন গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম জরুরি?

ওজন নিয়ন্ত্রণ ও রক্ত চলাচল বৃদ্ধি: কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত সহায়ক। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে, শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

শক্তি বৃদ্ধি ও মানসিক সুস্থতা: ব্যায়াম শক্তি বাড়ায়, ঘুমের চক্র ঠিক রাখে এবং স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেশন কমাতে কার্যকরী। এটি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়ক।

শারীরিক দৃঢ়তা ও ভারসাম্য: গর্ভাবস্থায় ওজন বাড়ার কারণে ভারসাম্যের সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে মজবুত করে এবং নমনীয়তা বাড়িয়ে এই সমস্যা দূর করে।

পেলভিক মাসলের শক্তি বৃদ্ধি: ডেলিভারির জন্য পেলভিক মাসলের শক্তি বৃদ্ধি করা জরুরি। এটি নরমাল ডেলিভারিতে সহায়ক হয় এবং সন্তান জন্মের পর পেটের নিচের অংশ থলথলে হওয়া রোধে সাহায্য করে। অনেক গর্ভবতী মায়ের প্রস্রাব ধরে রাখতে সমস্যা হয়, পেলভিক মাসলের ব্যায়াম এই সমস্যাও সমাধান করে।

গর্ভবতী মায়েদের জন্য নিরাপদ ব্যায়াম:

হাঁটা: গর্ভাবস্থায় হাঁটা সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম। নিজের শারীরিক ক্ষমতা বুঝে গতি ও সময় নির্ধারণ করে সমতলে নিয়মিত হাঁটুন।

ব্যায়াম বাইক ও ক্রস ট্রেনার: বাড়িতে এক্সারসাইজ বাইক থাকলে প্যাডেল করতে পারেন। ক্রস ট্রেনারও এক্ষেত্রে উপকারী।

সুইমিং ও অ্যাকোয়া অ্যারোবিক্স: সুইমিং অত্যন্ত উপকারী। কাছাকাছি অ্যাকোয়া অ্যারোবিক্স ক্লাস থাকলে সেখানে যেতে পারেন।

যোগব্যায়াম ও পিলাটিস: গর্ভাবস্থায় কিছু বিশেষ ধরনের যোগব্যায়াম এবং পিলাটিস দারুণ উপকার দেয়। তবে পেট বাড়ার সাথে সাথে যোগাভ্যাসের ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিতে হবে এবং সব ধরনের যোগব্যায়াম পরিহার করতে হবে। প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হালকা ওজন নিয়ে কোর এক্সারসাইজও করা যেতে পারে।

পেলভিক মাসলের ব্যায়াম: সন্তান জন্মের পর পেটের নিচের অংশ থলথলে হওয়া রোধ করতে এবং নরমাল ডেলিভারিতে সহায়তার জন্য পেলভিক মাসলের ব্যায়াম নিয়মিত করা উচিত।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ৪টি কার্যকর ব্যায়াম:

১. প্লাঙ্ক: এই ব্যায়ামের সময় শরীরের ভারসাম্যের দিকে খেয়াল রাখুন। ১০-২০ সেকেন্ড করে দুইবার করুন।
২. সাইড প্লাঙ্ক: এই ব্যায়ামটি চার-পাঁচ বার করতে পারেন। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা এখানেও গুরুত্বপূর্ণ।
৩. ব্রিজ: মেঝেতে সোজা হয়ে শুয়ে, পা মুড়ে পেটের দিকে টেনে কোমর উঁচুতে তুলে ধরুন। ২০ সেকেন্ড ধরে রেখে নামিয়ে নিন। এভাবে চার বার করুন। এটি পেলভিক মাসলের জন্য খুব ভালো ব্যায়াম।
৪. বার্ড ডগ এক্সারসাইজ: হামাগুড়ি পজিশনে যান। এবার ডান হাত সামনের দিকে এবং বাম পা পেছন দিকে সোজা করুন। অল্টারনেট করে মোট দশ বার করুন।

যে ব্যায়ামগুলি পরিহার করবেন:

শীর্ষাসন: গর্ভাবস্থায় শীর্ষাসন একেবারেই করা উচিত নয়।

উচ্চ-প্রভাবযুক্ত ব্যায়াম: দৌড়ানো, জগিং, লাফানো, সাইক্লিং (বিশেষত রাস্তায়), স্টেপ অ্যারোবিক্স এবং ভারী ওজন তুলে ব্যায়াম করায় নিষেধাজ্ঞা আছে।

ব্যায়ামের সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা:

শারীরিক অস্বস্তি: ব্যায়ামের সময় শরীর খারাপ লাগলে বা নিঃশ্বাসের কষ্ট, বুকে ব্যথা, পেশিতে টান বা পেটের কোনো অংশে যন্ত্রণা হলে অবিলম্বে ব্যায়াম বন্ধ করুন।

স্টিম বাথ ও সনা: গর্ভাবস্থায় সনা বা স্টিম বাথ না নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

সময়সীমা: একনাগাড়ে ৩০ মিনিটের বেশি ব্যায়াম করবেন না। সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়ামই যথেষ্ট।

শোয়ার ভঙ্গি: চিৎ হয়ে ১০ মিনিটের বেশি শুয়ে থাকবেন না।

জল পান: এক্সারসাইজের মাঝে অল্প অল্প জল পান করুন।

খাদ্যাভ্যাস: কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট পরে ব্যায়াম করুন।

সর্বোপরি, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নিজের শারীরিক অবস্থা বুঝে প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যারা আগে একেবারেই শারীরিক চর্চা করতেন না, তারা ধীরে ধীরে ব্যায়ামের সময় বাড়াবেন। মনে রাখবেন, সুস্থ মা মানেই সুস্থ শিশুর আগমণ।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy