টেনিস খেলোয়াড় রাধিকার মৃত্যুতে বড় সত্যি এল সামনে, সম্মান-হতাশা নাকি অন্য কোনো কারণ?

গুরগাঁওয়ের সুশান্ত লোক ফেজ-২-এ বৃহস্পতিবার ঘটে যাওয়া এক মর্মস্পর্শী ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা দেশ। নিজের প্রতিভাবান টেনিস খেলোয়াড় কন্যা রাধিকাকে গুলি করে হত্যা করেছেন স্বয়ং তাঁরই বাবা। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে—কী এমন ঘটল যে একজন পিতা তাঁর নিজ সন্তানকে এমন চরম পরিণতি দিলেন? প্রাথমিক জল্পনা এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন নানা দিক উন্মোচন করলেও, রাধিকার কাকার মন্তব্য এবং পুলিশের জেরার পর নতুন তথ্য সামনে আসছে, যা এই জটিল ঘটনার একাধিক স্তরকে তুলে ধরছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও নিকটাত্মীয়ের বয়ান:

ঘটনার আকস্মিকতা এবং নির্মমতা আরও স্পষ্ট হয় রাধিকার কাকা কুলদ্বীপ যাদবের বয়ানে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া তাঁর জবানবন্দি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ দোতলা থেকে বিকট গুলির শব্দ পেয়ে তিনি দ্রুত ওপরের তলায় ছোটেন। সেখানে তিনি তাঁর ভাইঝিকে রান্নাঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন, ততক্ষণে সব শেষ। ড্রয়িংরুমে পড়ে ছিল দীপকের ৩২ বোরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিভলভারটি। কুলদ্বীপ এবং তাঁর ছেলে পীয়ুস দ্রুত রাধিকাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এই মর্মান্তিক দৃশ্যের বর্ণনা ঘটনার বিভৎসতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কুলদ্বীপ নিশ্চিত করেছেন যে তাঁর দাদা দীপকই গুলি চালিয়েছেন। ঘটনার সময় দীপকের ছেলে ধীরজ ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলেন।

বাবার স্বীকারোক্তি: ‘কটাক্ষের শিকার’ নাকি ভিন্ন চিত্র?

পুলিশের প্রাথমিক জেরায় রাধিকার বাবা দীপক মেয়েকে খুন করার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, রাধিকার টেনিস অ্যাকাডেমি ভালো চলছিল, কিন্তু এই সাফল্যই পাড়া-প্রতিবেশীদের কটাক্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দীপকের ভাষ্যমতে, গ্রামের মানুষ তাঁকে উপহাস করে বলতেন যে তিনি মেয়ের টাকায় চলছেন। তিনি রাধিকাকে অ্যাকাডেমি বন্ধ করতে বললেও মেয়ে রাজি হননি। তাঁর দাবি, এই লাগাতার উপহাস ও কটাক্ষের জেরেই তিনি এমন চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তবে, এই দাবির পাশাপাশি ঘটনার পরপরই আরেকটি তথ্য সামনে আসে। প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, রাধিকার টেনিস খেলার পাশাপাশি ইনস্টাগ্রামে রিল বানানোর প্রতি আসক্তি ছিল। ঘটনার দিনও নাকি এই বিষয় নিয়েই বাবা-মেয়ের মধ্যে বচসা চরমে উঠেছিল। পুলিশের হাতে অভিযুক্ত বাবা গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি খুনে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

সামাজিক চাপ, সম্মানহানি নাকি পারিবারিক কলহ?

এই ঘটনা একটি গভীর সামাজিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দীপকের দাবি যদি সত্যি হয়, তবে এটি সমাজে ‘সম্মান’ এবং ‘পুরুষতান্ত্রিক অহংবোধ’-এর এক বিপজ্জনক দিক তুলে ধরে। মেয়ের সাফল্যে বাবার গর্বিত না হয়ে উল্টো সমাজের কটাক্ষে বিচলিত হয়ে এমন ভয়াবহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এক অস্থির সামাজিক মূল্যবোধের ইঙ্গিত দেয়।

অপরদিকে, যদি ইনস্টাগ্রাম রিল তৈরি নিয়ে বচসার কারণটি মূল হয়, তবে তা পারিবারিক কলহ এবং আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে পুরোনো ধ্যানধারণার সংঘাতের চিত্র তুলে ধরে। টেনিস অ্যাকাডেমির সাফল্য সত্ত্বেও যদি রিল তৈরি নিয়ে আপত্তি থাকে, তবে তা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের এক চরম দৃষ্টান্ত হতে পারে।

পুলিশ এই ঘটনার একাধিক দিক খতিয়ে দেখছে। সামাজিক চাপ, মানসিক অস্থিরতা, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন—এই সব দিকই তদন্তের আওতায় আসবে। রাধিকার হত্যা কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি আমাদের সমাজ, তার মূল্যবোধ এবং পারিবারিক কাঠামোর গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু অন্ধকার দিকের প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনা আমাদের বাধ্য করছে প্রশ্ন তুলতে—একটি সফল মেয়ের জীবন কেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি পেল, এবং সমাজের কোন দৃষ্টিভঙ্গি এই ধরনের ট্র্যাজেডির জন্ম দিচ্ছে?

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy