সিঙ্গুরের ছায়া কাটিয়ে নতুন অধ্যায়ে বাংলা? নবান্নে মমতা-চন্দ্রশেখরণ বৈঠক ঘিরে শিল্পের নয়া জল্পনা

সিঙ্গুর-পর্বের তিক্ত অতীতকে পেছনে ফেলে এবার এক নতুন শিল্প-দিগন্তের স্বপ্ন দেখছে পশ্চিমবঙ্গ। আর সেই স্বপ্নের প্রধান অনুঘটক হিসেবে উঠে এসেছে টাটা গোষ্ঠী। পুজোর মরশুম শেষ হতে না হতেই রাজ্যে ফের শিল্প সম্মেলনের যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে, তাকে আরও জোরালো করল বুধবারের এক হাই-প্রোফাইল বৈঠক। এদিন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করলেন, যা বাংলার শিল্পমহলে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে।

বদলে যাওয়া শিল্পনীতি, টাটার প্রত্যাবর্তন?

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ ও টাটা গোষ্ঠীর সম্পর্কে এক অস্বস্তিকর নীরবতা ছিল। বহু রাজ্য যখন শিল্প লগ্নি টানতে মরিয়া, পশ্চিমবঙ্গ যেন কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। তবে বিগত কয়েক বছরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজ্যের শিল্পনীতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা হ্রাস পেয়েছে, শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো উন্নত হয়েছে এবং দেশি-বিদেশি লগ্নিকারীদের আকৃষ্ট করতে সরকার একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই অংশ হিসেবে টাটার এই শীর্ষস্থানীয় বৈঠককে দেখছে রাজনৈতিক ও শিল্পমহল।

বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের প্রভাব

বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন (BGBS) এই পরিবর্তনের অন্যতম বড় উদাহরণ। প্রতি বছর এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের বড় শিল্পপতিদের উপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সম্ভাবনা তুলে ধরেন। গতবার টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরন নিজে উপস্থিত না থাকলেও, তাঁর প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনেও তাঁর কথা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছিল— টাটা কি তাহলে আবার বাংলায় ফিরছে? আজকের বৈঠক সেই জল্পনাকে যেন একরকম সত্যি বলেই প্রমাণ করল।

নবান্নে রুদ্ধদ্বার বৈঠক: কিসের ইঙ্গিত?

বুধবার বিকেলে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন চন্দ্রশেখরন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। সেই ছবি তৃণমূল কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টেও শেয়ার করা হয়েছে, যা এই বৈঠকের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যদিও বৈঠক কী নিয়ে হয়েছে, তা নিয়ে সরকারিভাবে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি, তবে প্রশাসনিক মহলের খবর, টাটা গোষ্ঠীর তরফে পশ্চিমবঙ্গে নতুন প্রকল্পের রূপরেখা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রিক ভেহিকল (EV) উৎপাদন, রিনিউয়েবল এনার্জি এবং কনসালটেন্সি পরিষেবা— এই কয়েকটি ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রবল। টাটা মেডিকেল বা টাটা গ্রুপের অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্যোগ নিয়েও আলোচনার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

রাজনৈতিক ও শিল্পগত গুরুত্ব

এই বৈঠকের রাজনৈতিক গুরুত্বও নেহাত কম নয়। বিরোধীরা বরাবরই রাজ্যের শিল্পনীতির সমালোচনায় সরব। সেই প্রেক্ষিতে টাটা গোষ্ঠীর এই হাই-প্রোফাইল সাক্ষাৎ রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তিকে নিঃসন্দেহে আরও জোরালো করেছে। শিল্পমহলের মতে, “এই বৈঠক নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সংকেত। মুখ্যমন্ত্রী নিজে যখন শিল্পপতিদের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত থাকেন, তখন লগ্নিকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে।”

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী ও টাটা সন্স চেয়ারম্যানের বৈঠক রাজ্যে নতুন করে শিল্পের আবহ তৈরি করেছে। পুজোর পর ফের আয়োজিত হতে চলা বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন ঘিরে এখন নতুন করে আশাবাদী রাজ্য। টাটা গোষ্ঠী যদি আবার পশ্চিমবঙ্গে বড় মাপের কোনো প্রকল্প শুরু করে, তবে তা যে শুধু কর্মসংস্থানের দিক থেকেই নয়, বরং বাংলার শিল্পচিত্রে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy