দ্রুত ওজন কমানোর মোহ মানুষকে প্রায়শই ভুল পথে চালিত করে। না খেয়ে বা একতরফা ডায়েট করে ওজন ঝরানোর প্রবণতা এখন অনেকটাই বেড়েছে, যা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পুষ্টিবিদরা জোর দিয়ে বলছেন, ওজন কমানোর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, কোনো রাতারাতি সমাধান নয়।
কেন বাড়ছে ওজন? আধুনিক জীবনযাত্রাই কি দায়ী?
বয়স, উচ্চতা ও লিঙ্গ অনুযায়ী দেহের স্বাভাবিক ওজনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। কিন্তু বর্তমানের জীবনযাপনে সেই সমীকরণ অনেকটাই বদলে গেছে। দীর্ঘ সময় টিভি বা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, এবং মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকার কারণে কায়িক পরিশ্রম কমে গেছে। এছাড়াও, হাঁটার পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবও ওজন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকেই সারাদিন না খেয়ে দিনে মাত্র এক-দু’বার বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করেন, যার ফলে শরীরে ক্যালরির মাত্রা বেড়ে যায়। জাঙ্ক ফুড এবং ফাস্ট ফুড জাতীয় খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত তেল, চর্বি, মশলা ও লবণ থাকায় দ্রুত ওজন বাড়ে এবং শরীরের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়।
অতিরিক্ত ওজনের ভয়াবহ জটিলতা: ডায়াবেটিস থেকে স্ট্রোকের ঝুঁকি
অতিরিক্ত ওজন কেবল স্থূলতাই নয়, ডেকে আনে অসংখ্য জটিলতা। ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যাওয়ায় অল্প বয়সেই ডায়াবেটিসের মতো রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ফ্যাটি লিভার, এবং কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। তবে আশার কথা হলো, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে এই সমস্ত শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ওজন কমাতে যা করণীয়: পুষ্টিবিদদের জরুরি পরামর্শ
১. এক-দু’বার খাবার অভ্যাস ত্যাগ করুন: সারা দিনে এক বা দুইবার বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করলে দেহে অতিরিক্ত ক্যালরি প্রবেশ করে, যা দ্রুত মুটিয়ে যাওয়ার কারণ। নিয়মিত বিরতিতে অল্প অল্প করে খান।
২. সুষম আহার অপরিহার্য: প্রোটিন জাতীয় খাদ্য বাদ দিয়ে কেবল সবজি বা ফল খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না। সুষম বা ব্যালান্সড ডায়েট মেনে না চললে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেলের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখুন।
৩. জাঙ্ক ফুড ও ফাস্ট ফুড পরিহার: জাঙ্ক ফুড এবং ফাস্ট ফুড জাতীয় খাদ্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন। এগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত তেল, চর্বি, মশলা এবং লবণ থাকায় দ্রুত ওজন বাড়ে এবং শরীরের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম: প্রয়োজন ছাড়া বেশি রাত জাগবেন না। কারণ রাত জাগলে ক্ষুধা লাগে এবং বেশি খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, যার ফলে ওজন বৃদ্ধি হয়। পর্যাপ্ত ঘুম ওজন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. কার্বোহাইড্রেট বাদ দেবেন না: কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার হঠাৎ করে একেবারে বাদ দেবেন না। এতে মাথাব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, দুর্বলতা, অবসাদ, চামড়ায় ফুসকুড়ি, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিমিত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করুন।
৬. নাশতা জরুরি: সকালের নাশতা কোনো অবস্থাতেই বাদ দেবেন না। সকালের নাশতার তিন-চার ঘণ্টা পর হালকা কোনো স্বাস্থ্যকর নাশতা গ্রহণ করুন।
৭. চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ: ওজন কমানোর আগে অবশ্যই কিছু রুটিন টেস্ট (যেমন: রক্তে সুগারের মাত্রা, কোলেস্টেরল, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক অ্যাসিড) করিয়ে নিন। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে একজন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার জন্য সঠিক ওজন কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
মনে রাখবেন, সুস্থ উপায়ে ওজন কমানো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সঠিক পদ্ধতি মেনে চললে দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া সম্ভব।