পঞ্চাশের ঘরে পা রাখতেই রহমান সাহেবের মতো অসংখ্য মানুষের কাছে হাঁটু ও কোমরের ব্যথা যেন নিত্যসঙ্গী। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে বা টয়লেটে বসতে গেলেই তীব্র যন্ত্রণায় কাবু হয়ে পড়েন তারা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই জয়েন্টের ব্যথাকে বলা হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)। একসময় কেবল বয়স্কদের সমস্যা হিসেবে পরিচিত এই রোগটি এখন উদ্বেগজনক হারে কম বয়সীদের মধ্যেও বাড়ছে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস কী এবং কেন হয়?
অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলো এক ধরনের ক্ষয়জনিত অস্থিসন্ধির রোগ, যা মূলত হাড়ের সংযোগস্থলের কার্টিলেজ (Cartilage) ভেঙে যাওয়ার কারণে ঘটে। আমাদের দেহের দুটি হাড়কে ঘিরে থাকা এই কার্টিলেজ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নানা কারণে ক্ষয়ে যায়। হাত, পা, কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমেরিকায় প্রতি ৭ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ১ জন এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। এর সাধারণ লক্ষণ হলো জয়েন্টে ব্যথা এবং জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া, যা দৈনন্দিন কাজকর্মেও গুরুতর বাধা সৃষ্টি করে।
জীবনযাত্রাই মূল কারণ: ঝুঁকিতে কারা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা। ভুল খাদ্যাভ্যাস, দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে কাজ করা এবং শারীরিক চর্চার অভাব এই রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ব্যায়াম বা হাঁটাচলার অভাবে জয়েন্টকে ঘিরে থাকা কার্টিলেজ তার কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে।
এসবের পাশাপাশি, নিয়মিত অতিরিক্ত ওজন তোলা, জয়েন্টে পুরোনো আঘাত, জয়েন্ট ইনজুরি, ডায়াবেটিস, পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে এই রোগের ইতিহাস, হরমোনের সমস্যা এবং ধূমপানের অভ্যাসও অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। মেনোপোজ হয়ে যাওয়া নারী এবং খেলাধুলায় যুক্ত ব্যক্তিরাও এই রোগের ঝুঁকিতে থাকেন।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস নিয়ন্ত্রণ: খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
অস্টিওআর্থ্রাইটিস রাতারাতি সারানো সম্ভব নয়, তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস:
দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার: প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি থাকায় হাড় শক্তিশালী করে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ: রুই, স্যামন, ইলিশ ইত্যাদি মাছ জয়েন্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
বাদাম: কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোটের মতো বাদামে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, ভিটামিন ই ও ফাইবার থাকে, যা অস্টিওআর্থ্রাইটিস নিরাময়ে অত্যন্ত সহায়ক।
শিমের বীজ: এতে থাকা প্রোটিন, লৌহ, জিঙ্ক ও পটাশিয়াম বাতের কারণে সৃষ্ট ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি যুক্ত ফল: কমলালেবু, পাতিলেবু, মুসম্বি ও আঙুরের মতো ফল হাড়ের ক্ষয় কমাতে সাহায্য করে।
গ্রিন টি: হাড়ের ব্যথায় স্বস্তি পেতে নিয়মিত গ্রিন টি পান করতে পারেন।
কারকুমা জয়েন্ট গার্ড: এটি একটি কার্যকরী ফাংশনাল ফুড যা জয়েন্টগুলোকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে, ব্যথা, চাপ এবং জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া থেকে প্রাকৃতিক স্বস্তি দেয়। এটি জয়েন্টের গতিশীলতা ও নমনীয়তা বাড়ায় এবং প্রদাহ হ্রাস করে।
ওজন হ্রাস ও শারীরিক চর্চা:
অতিরিক্ত ওজন অস্টিওআর্থ্রাইটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। নিয়মিত কিছুটা সময় হলেও ব্যায়াম করুন। ভারী ব্যায়ামের সময় না পেলে কাজের ফাঁকে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন বা অন্তত ১০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত হাঁটুর ব্যায়াম করলে উপকার পাবেন।
চিকিৎসা পদ্ধতি: বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অপরিহার্য
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের অন্যতম কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ফিজিওথেরাপি। এছাড়া অনেকে হিজামা থেরাপি বা আকুপাংচারও করিয়ে থাকেন। আক্রান্ত জয়েন্টে এই ধরনের থেরাপি প্রয়োগ করলে জয়েন্টগুলো ধীরে ধীরে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। তবে আপনার জন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতিটি সবচেয়ে উপযুক্ত, তা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেওয়া আবশ্যক। মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং নিয়মিত চিকিৎসা ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলে এই রোগের প্রকোপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।