পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) দুর্নীতিতে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখন হাইকোর্টের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল হয়েছে। এই তালিকায় ছিলেন ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষিকা সোমা দাসও। তবে, আদালত মানবিক দিক বিবেচনা করে তার চাকরি বহাল রাখার নির্দেশ দেয়। আদালতের এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালেও, রাজ্যের দৃষ্টিহীন এবং বিশেষভাবে সক্ষম প্রাক্তন শিক্ষকরা এখন সেই দৃষ্টান্তকে সামনে এনে নিজেদের চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে সরব হয়েছেন। তাদের একটাই প্রশ্ন: ‘সোমার চাকরি টিকলে আমাদের নয় কেন?’
দৃষ্টিহীন শিক্ষকদের বঞ্চনা ও দাবি
অল বেঙ্গল ব্লাইন্ড টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাপস রায় জানান, ২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেল বাতিলের ফলে প্রায় ৭০ জন দৃষ্টিহীন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। “তারা সকলেই পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেয়েছিলেন। তাদের অযোগ্য বলার কোনো সুযোগ নেই,” তাপস রায় বলেন। “আদালত যদি সোমা দাসের বিষয়ে মানবিক হতে পারে, তাহলে আমাদের বেলাতেও সেই মানবিকতা দেখানো উচিত।”
দৃষ্টিহীন পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষা প্রক্রিয়া সাধারণ পরীক্ষার্থীদের থেকে ভিন্ন। তাদের একজন ‘রাইটার’ বা লেখকের প্রয়োজন হয়, যিনি প্রশ্ন শুনে উত্তর লেখেন। অনেক সময় এই ‘রাইটার’ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে ওঠে, যা তাদের পরীক্ষার অভিজ্ঞতাকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কঠোর পরিশ্রম, লড়াই এবং সাফল্য আরও বেশি মূল্যবান। তাই তারা সরকার এবং বিচারব্যবস্থার কাছে তাদের প্রতি একটি আলাদা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের আর্জি জানিয়েছেন।
ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষকের করুণ আর্তি
শুধু দৃষ্টিহীনরাই নন, সায়নগরের শিক্ষক ভাওয়ালও ক্যানসার আক্রান্ত হয়েও চাকরি হারিয়েছেন। তিনি বিধাননগরের কুরবান আলি হাই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। “আমি চিকিৎসার মধ্যে আছি, নিয়মিত কেমো চলছে। আমার শরীর আর্থিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে,” ভাওয়াল বলেন। “আমার চাকরিও যদি ফিরিয়ে না দেওয়া হয়, তাহলে কোথায় দাঁড়াব?” তার এই প্রশ্ন সমাজের আরও অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
আইন ও মানবিকতার সংঘাত
এই ঘটনা একদিকে আইন এবং অন্যদিকে মানবিকতার মধ্যে একটি প্রশ্ন তৈরি করেছে। আইন কি কেবল শাস্তি দেওয়ার জন্য, নাকি এটিও মানবিকতা বিবেচনা করতে পারে? আদালত অতীতে বহুবার অসুস্থতা বা পারিবারিক দুর্দশার ভিত্তিতে মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত যদি নির্বাচিতভাবে কিছু মানুষকে দেওয়া হয় এবং বাকিদের বঞ্চিত করা হয়, তাহলে তার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
দৃষ্টিহীন এবং বিশেষভাবে সক্ষম প্রাক্তন শিক্ষকরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চান। তারা চান, সরকার ও বিচারব্যবস্থা তাদের দিকেও তাকাক, যেন শুধু আইন নয়—মানবিকতাও তাদের পাশে দাঁড়ায়। নিজেদের দাবি আদায়ে তারা রাজপথে নেমে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের স্পষ্ট বার্তা: “আমরা অযোগ্য নই, আমরা প্রতিবন্ধী। আমরা চাই, আমাদের লড়াইয়ের কদর হোক, আমাদের প্রাপ্য আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক।”
রাষ্ট্র যদি সত্যিই মানবিক হয়, তাহলে তাদের এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া উচিত—”সোমার চাকরি থাকলে আমাদের নয় কেন?”