বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যানসারের পাশাপাশি জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যাও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। সঠিক চিকিৎসা না করালে এই ক্যানসার প্রাণঘাতী হতে পারে। তবে যারা প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করেন, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ৯৫ শতাংশ।
আমাদের দেশে প্রতি বছর আট হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং পাঁচ হাজারের বেশি নারী এই রোগে প্রাণ হারাচ্ছেন। এই মর্মান্তিক প্রাণহানি কমাতে রোগটির কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধের উপায় ও চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনোকলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারহানা খাতুন এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য ও পরামর্শ দিয়েছেন।
জরায়ুমুখ ক্যানসার কী এবং কত প্রকার?
নারীর প্রজননতন্ত্রের জরায়ুর দুটি অংশ – বডি এবং জরায়ুমুখ (সার্ভিক্স)। সার্ভিক্সে যখন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রমণের ফলে কিছু পরিবর্তন ঘটে এবং ধীরে ধীরে তা ঘায়ে পরিণত হয়ে ক্যানসারে রূপ নেয়, সেটাই জরায়ুমুখের ক্যানসার। জরায়ুর বডির ক্যানসার এবং জরায়ুমুখের ক্যানসারের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রধান ঝুঁকির কারণগুলো হলো – অল্প বয়সে বিয়ে, কম বয়সে একাধিক সন্তান জন্মদান এবং অল্প বয়সে প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়া ইত্যাদি।
জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ ও উপসর্গ:
জরায়ুমুখ ক্যানসারের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রায় ৭০ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা অ্যাডভান্সড স্টেজে এসে রোগটি সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ থাকে না। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন রোগ অনেকটাই ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই জরায়ু ক্যানসারকে ‘নীরব ঘাতক’ বা ‘সাইলেন্ট কিলার’ বলা হয়। কিছু সম্ভাব্য লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
নিম্ন পেটে চাপ অনুভব করা অথবা ঘন ঘন মূত্রত্যাগ করা।
গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা হালকা খাবার গ্রহণের পরই পেট ভরা লাগা এবং পেটে অস্বস্তি অনুভব করা।
পেটে অতিরিক্ত ব্যথা অথবা পেট ফুলে থাকা, এর সাথে বমি বমি ভাব অথবা বারবার বমি হওয়া, যার ফলে ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি অথবা হঠাৎ করে ওজন অনেক কমে যাওয়া।
প্রথম দিকে সাদা স্রাব এবং পরবর্তীতে গন্ধযুক্ত বা রক্তমিশ্রিত সাদাস্রাব।
যৌন সম্পর্কের সময় রক্তপাত হওয়া জরায়ু ক্যানসারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। সহবাসের সময় রক্তপাত হলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
মাসিক অনিয়মিত হওয়া, দুই মাসিকের মাঝে অনিয়মিত রক্তস্রাব অথবা মাসিক এতটাই অনিয়মিত হওয়া যে তারিখ শনাক্ত করা কঠিন।
মেনোপজ হওয়ার পরেও রক্তপাত দেখা গেলে, সেটিও জরায়ু ক্যানসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এছাড়াও, তলপেটে ব্যথা, কোমর ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া ও পায়ে জল আসা জরায়ু ক্যানসারের অ্যাডভান্সড স্টেজের লক্ষণ।
জরায়ু ক্যানসার হওয়ার মূল কারণ:
১৩-১৪ বছর বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ে হলে, তার যোনিপথের কোষ কলাগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিণত হওয়ার আগেই যৌন সংস্পর্শে আসা জরায়ু ক্যানসারের একটি বড় ঝুঁকির কারণ।
যারা কম বয়সে সন্তান ধারণ করে, অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে, একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌন সম্পর্ক রাখে, শারীরিক সম্পর্কের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস ক্যানসারে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এই কারণগুলোর জেরেই বাংলাদেশ জরায়ু ক্যানসারের ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ এই রোগের প্রায় সকল ঝুঁকিপূর্ণ কারণই বাংলাদেশে বিদ্যমান।
জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়:
প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য ১৩-১৫ বছর বয়সের কিশোরীদের এইচপিভি টিকা (HPV Vaccine) দেওয়া অপরিহার্য। এই ভ্যাকসিন প্রায় ১০০ ভাগ সুরক্ষা দিতে সক্ষম। তবে টিকা গ্রহণের পাশাপাশি তাদের নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনাও জরুরি। এছাড়াও, জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয় প্রতিরোধ হলো – স্ক্রিনিং সেন্টারে গিয়ে সুস্থ মায়েদের নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো। স্ক্রিনিংয়ের প্রধান তিনটি পদ্ধতি হলো – পেপস স্মেয়ার টেস্ট (Pap Smear Test), ভায়া টেস্ট (VIA Test) এবং এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট (HPV DNA Test)। এই টেস্টগুলোর মাধ্যমে জরায়ুমুখের ক্যানসারের পূর্ব লক্ষণ শনাক্ত করা যায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব।