শ্বাস-প্রশ্বাসকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়ায় অনেকেই হয়তো এটি নিয়ে আলাদা করে ভাবেন না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসকে ভিন্নভাবে কাজে লাগালে তা সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং পিসা ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক এঞ্জেলো জেমিগনানি বলেন, “পারস্পরিক সচেতন এবং অবচেতন অবস্থার একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া। ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষায় এটি সাহায্য করে।”
সেল রিপোর্ট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গবেষণা মতে, প্রতিদিন মাত্র পাঁচ মিনিটের শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ব্যক্তিকে মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখে এবং দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘ এক মাস ধরে এ চর্চা করলে তা একই সময় নিয়ে করা অন্য মানসিক ব্যায়ামের থেকেও অধিক কার্যকরী হবে।
গবেষণাটির সাথে সংশ্লিষ্ট গবেষক ডেভিড স্পিজেল বলেন, “আমরা সবসময় এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাই না। এক্ষেত্রে মাত্র কয়েক মিনিট সময় নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করলে তা শরীরের জন্য দারুণ কার্যকরী। একইসাথে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রেও ব্যক্তিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে।”
গবেষণায় ১০৮ জন প্রাপ্তবয়স্ককে স্যাম্পল হিসেবে নিয়ে ভিন্নধর্মী মোট তিন ধরণের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ব্যায়াম করানো হয়েছে। এক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীরা বাড়িতে বসেই ভিডিওতে নির্দেশকদের তত্ত্বাবধানে ব্যায়াম করা হয়েছে।
প্রথম গ্রুপের মানুষদেরকে চক্রাকার পদ্ধতিতে দীর্ঘশ্বাস গ্রহণের ব্যায়াম করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমে নাক নিয়ে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ফুসফুসে বাতাস ভর্তি করা হয়। এরপর ফুসফুস প্রায় বাতাসে ভরে গেলে ধীরে ধীরে সেই বাতাসকে মুখ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় গ্রুপের মানুষদেরকে বক্স পদ্ধতিতে শ্বাস নিতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রথমে ধীরে ধীরে বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করানো হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবার প্রবেশের আগে একটু বিরতি নিয়ে বাতাস ধরে রাখা হয়। পরবর্তীতে একই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বাতাস বের করে দেওয়া হয় ও মাঝে মাঝে বিরতি নিতে হয়।
তৃতীয় গ্রুপের অংশগ্রহণকারীদেরকে সাইক্লিক হাইপারভেন্টিলেশন পদ্ধতিতে ব্যায়াম করতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্বাস ছাড়ার থেকে গ্রহণের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অনেকটা চক্রাকারে দীর্ঘশ্বাস গ্রহণের মতোই। প্রথমে নাক দিয়ে দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে শ্বাস নেওয়া হয়, পরে আপনা-আপনিই সে বাতাস মুখ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এ ব্যায়ামের প্রতি ৩০ চক্র পর ১৫ সেকেন্ড ইচ্ছাকৃতভাবে বাতাস আটকিয়ে রাখা হয়।
অন্যদিকে চতুর্থ গ্রুপের অংশগ্রহণকারীরা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। এই গ্রুপের সদস্যরা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম না দিয়ে বরং নিজেদের শারীরিক ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত পরামর্শের মাধ্যমে মননশীলতার ব্যায়াম করেছেন।
২৮ দিন পর সকল গ্রুপের অংশগ্রহণকারীরা পূর্বের তুলনায় মানসিকভাবে ভালো বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। এমনকি অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত জীবনে দুশ্চিন্তার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ এবং আচরণগত বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্পিজেল বলেন, “মাত্র পাঁচ মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করে এ ফলাফল ইতিবাচক। ব্যক্তি এ ব্যায়ামের মাধ্যমে নিজের কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।”
তবে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত এ ব্যায়ামের ফলাফল সাথে সাথেই পাওয়া যাবে না। বরং প্রতিনিয়ত এ ব্যায়াম করলে ধীরে ধীরে তার ফলাফল পেতে শুরু করবে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মধ্যে চক্রাকারে দীর্ঘশ্বাসের ব্যায়ামটি সবচেয়ে কার্যকরী। এই গ্রুপের অংশগ্রহণকারীরা মননশীলতার ব্যায়াম করা ব্যক্তিদের থেকেও মানসিকভাবে বেশি প্রশান্তি লাভের কথা জানিয়েছেন।
যখন কেউ উদ্বিগ্ন থাকে, তখন দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ব্যক্তির শ্বাস ধীরে ধীরে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসে। গবেষণা মতে, এটি মানসিকভাবে সাবলীল করার পাশাপাশি ব্যক্তির শারীরিক অবস্থাও অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসে।
জেমিনির এক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ধীরগতির শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ব্যক্তির হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসকে ইতিবাচকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
স্পাইজেল বলেন, “হাইপোথিসিস অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের ফলে স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম প্রশান্তিদায়ক অবস্থায় পৌঁছে এবং ব্যক্তি মানসিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে থাকে। এ ব্যায়ামের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের শারীরিক কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটা সত্যিই খুব ভালো একটি অনুভূতি।”
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের সময় নাকের যে ব্যবহার, সেটিও স্নায়ুর ওপর ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে। ব্যায়ামের সময় ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়ার ফলে মস্তিষ্কের ঘ্রাণতন্ত্রও উজ্জীবিত হয়। এ ব্যায়াম ব্যক্তির মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদী কী প্রভাব ফেলে সেটি নিয়েও গবেষণা করার পরিকল্পনা করছেন স্পাইজেল।
গবেষণায় শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের কয়েকটি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে চক্রাকারে দীর্ঘশ্বাস ব্যায়াম যে সবচেয়ে কার্যকরী, সেটিও প্রমাণিত হয়েছে। তবে ব্যক্তি নিজের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী তিন ধরণের ব্যায়ামের যেকোনো একটিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
ব্যায়ামটি করার জন্য প্রথমে অল্প অল্প অনুশীলনের মাধ্যমে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে ব্যায়ামগুলো করে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে বের করতে হবে।
তবে ব্যায়ামটি যে একেবারে পাঁচ মিনিট সময় ধরেই করতে হবে এমনটি নয়। কেউ চাইলে এর বেশি সময় নিয়েও ব্যায়ামটি করতে পারে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামগুলোর সুবিধা হচ্ছে, এর জন্য আলাদা প্রস্তুতির দরকার নেই। বরং প্রায় সকল পরিস্থিতিতেই সময় বের করে ব্যায়ামটি করা যায়। যেমন চলতি পথে কিংবা সাঁতারের সময় খুব সহজেই বক্স পদ্ধতিতে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামগুলো করা যাবে।