দেশের সর্বোচ্চ রেল ব্রিজের নেপথ্যে ‘এক মহিলা’! চেনাব ব্রিজ নিয়ে মুখ খুললেন মাধবী লতা, বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার!

দেশের সর্বোচ্চ সিঙ্গল আর্চ রেলওয়ে ব্রিজ, চেনাব ব্রিজ—২০২৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যার উদ্বোধন করেছিলেন। জম্মু ও কাশ্মীরের চেনাব নদী থেকে ৩৫৯ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই বিস্ময়কর সেতুর নেপথ্যে যিনি কারিগর হিসেবে ছিলেন, তিনি একজন মহিলা। তাঁর নাম মাধবী লতা গালি। আইআইএসসি (IISC), বেঙ্গালুরুর এই অধ্যাপিকাকে সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগে ‘রামোজি রাও অ্যাওয়ার্ড অফ এক্সিলেন্স’-এ সম্মানিত করেছে রামোজি গ্রুপ।

মাধবী লতা গালি সম্প্রতি ইটিভি ভারতের সিদ্ধার্থ রাও-কে একটি বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর কেরিয়ারের একাধিক অজানা দিক ও গুরুত্বপূর্ণ দর্শন।

চেনাব ব্রিজের ডিজাইনার: ‘নিজেকে পুরুষদের মতোই মনে করি’

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): আপনি আইআইএসসি-র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম মহিলা অধ্যাপিকা এবং চেনাব ব্রিজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে আপনার অবদান অনস্বীকার্য। কেমন লাগছে?

মাধবী লতা (উ): অধ্যাপিকা হিসেবে তো কাউকে প্রথমে আসতেই হতো—আমিই সেই হিসেবে এসেছি, এভাবেই মনে করি। চেনাব ব্রিজের ডিজাইনার টিমের সদস্য হতে পেরে সত্যিই খুব গর্ব অনুভব করি।

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): অন্ধ্রপ্রদেশের মহিলারা হার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ খুব একটা আসেন না। আপনি কেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নিলেন?

মাধবী লতা (উ): সত্যি বলতে, আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাধ্য হই, কারণ তাঁরা মনে করতেন ডাক্তারি শুরু করে রোজগার করতে অনেক সময় লাগে এবং ক্লিনিক তৈরির জন্য অনেক অর্থ প্রয়োজন। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং আমার প্রথম পছন্দের বিষয় ছিল না, আমি ইলেকট্রনিক্স পাইনি। তাই দ্বিতীয় পছন্দের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছিলাম।

‘স্টিরিয়োটাইপ মেন্টালিটি’ তো আছেই। অনেকেই বলতেন, মহিলারা এখানে যাবেন, ওখানে যাবেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটা মনে করি না। আমি নিজেকে একজন পুরুষ মানুষের মতোই মনে করি, কোনও বাধার সম্মুখীন হইনি।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও ‘সাস্টেনেবিলিটি’র নতুন সংজ্ঞা

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): মেকানিক্যাল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মহিলাদের সমস্যা হয় বলে মনে করা হয়। আপনি কি কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?

মাধবী লতা (উ): না, মহিলা হওয়ার জন্য আমি কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। তবে মাঠে ময়দানে কাজ করার সময় শারীরিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, আমি মনে করি সেই ক্ষমতা আমাদের আছে। মহিলারা মহাকাশে যাচ্ছেন। আপনি যদি দেশকে তৈরি করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, তবে এই প্রফেশন আপনার জন্য। শুধু অফিসের ভিতরে ৯টা থেকে ৫টা কাজ করলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং আপনার জন্য নয়।

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): চেনাব ব্রিজের ডিজাইন একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। কীভাবে কাজ করলেন?

মাধবী লতা (উ): এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজাইনও পরিবর্তন হয়েছে, কারণ পাহাড়ের আকারও পরিবর্তিত হয়। ভারতীয় রেল, কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং আমাদের মতো ডিজাইনারদের যৌথ প্রচেষ্টায় এই প্রজেক্ট তৈরি হয়েছে।

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): আপনি আইআইএসসি-র সাস্টেনেবিলিটি টেকনোলজির চেয়ারম্যান। চেনাব ব্রিজে বিপুল কংক্রিট ব্যবহারকে অনেকেই পরিবেশবান্ধব বলেন না। আপনি ‘সাস্টেনেবিলিটি’ বা স্থায়িত্বকে কীভাবে দেখেন?

মাধবী লতা (উ): সাস্টেনেবিলিটির অর্থ শুধুমাত্র একটি বিষয় নয়, এটি লাইফ সাইকেলের একটা অঙ্গ। চেনাব রেলওয়ে ব্রিজ জম্মু রিজিয়নের একমাত্র সংযোগ, যেখানে বন্যায়ও কোনো সমস্যা হয় না। বন্যা বা রাস্তা বন্ধ থাকার সময় এই ব্রিজের জন্যই সরকার ত্রাণকার্য চালাতে পেরেছে।

আরেকটি উদাহরণ দিই, আপেল এক্সপ্রেস ট্রেন চলছে। অনন্তনাগ থেকে আপেল দিল্লি সহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এটাই সাস্টেনেবিলিটি। আমরা নদীকে কোনো রকম সমস্যায় না ফেলে একটা বিরাট ব্রিজ তৈরি করেছি, নদীর গতিপথকেও বন্ধ করিনি। এমনকি জম্মু ও শ্রীনগরের মধ্যে ট্রাভেল টাইম প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে এই ব্রিজের জন্য।

লিঙ্গবৈষম্য ও সাফল্যের বার্তা

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): STEM (বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-ইঞ্জিনিয়ারিং-অঙ্ক)-এর দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ৭৫ জন মহিলার মধ্যে আপনি একজন। মহিলারা লিঙ্গের গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসছেন। এ নিয়ে কী বলবেন?

মাধবী লতা (উ): লিঙ্গবৈষম্য এখনও আছে। দু দিক থেকেই পরিবর্তন আসা জরুরি। মহিলাদেরও আরও সাহসী হতে হবে, অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিগুলিকেও মহিলাদের ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। মহিলারা অনেক দায়িত্ব অতি যত্ন নিয়ে করেন। পরিবর্তন হচ্ছেই, এখন সিইও পদে একাধিক মহিলা রয়েছেন।

সিদ্ধার্থ রাও (প্র): আপনার জার্নি থেকে আপনি একজন মহিলা হয়ে কী বার্তা দেবেন?

মাধবী লতা (উ): স্বপ্ন দেখা ভালো, কিন্তু এরসঙ্গে নিজের ঊর্ধ্বসীমাও জানা জরুরি। আমি আজ যে জায়গায় পৌঁছেছি, তা একদিনে নির্দিষ্ট হয়ে যায়নি। কোনো সুযোগ এলে আমি কখনই ‘না’ করিনি। সবাই সবকিছু করতে পারে না। সুতরাং আপনি যে কাজে পারদর্শী সেই দিকেই যাওয়া উচিত। আমি যে রামোজি রাও অ্যাওয়ার্ড অফ এক্সিলেন্স পেলাম, সেটা শুধু চেনাব ব্রিজ তৈরির জন্য নয়—পুরোটাই আমার কঠিন পরিশ্রমের জন্য।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy