একসময় ছিল, যখন ভারতের মসলিন, রেশম এবং হস্তশিল্পের চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্যে ইউরোপীয় বাজার মুগ্ধ ছিল। বিদেশি বণিকদের হাত ধরে ইউরোপের বাজার ছেয়ে থাকত ভারতের রেশম, সুতির বস্ত্র ও নানান হস্তশিল্পের সম্ভারে। কিন্তু শিল্প বিপ্লব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক আগ্রাসনে উল্টে গেল সেই রমরমা। বিদেশের কলজাত কাপড়ের কাছে হার মেনে বাজার থেকে বিদায় নিতে শুরু করল ঐতিহ্যবাহী মসলিন এবং রেশম বালুচরী শাড়ির মতো শিল্পকর্ম।
ঐতিহ্যবাহী বালুচরী: উৎপত্তি ও বর্তমান অবস্থা
ঐতিহাসিকদের মতে, বালুচরীর উৎপত্তি অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ যখন তাঁর রাজধানী ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে (মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত করেন, তখন তিনি বেগমদের জন্য শাড়ি বোনার বরাত দেন মুর্শিদাবাদের বালুচর গ্রামের দক্ষ কারিগরদের। তাঁদের হাতেই নানান পৌরাণিক কাহিনী বুকে নিয়ে গড়ে ওঠে রেশমের বিখ্যাত বালুচরী শাড়ি। একসময় মুর্শিদাবাদ খ্যাতি লাভ করেছিল পূর্ব ভারতের ‘সিল্ক মক্কা’ হিসেবে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মোঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা এই শিল্পকে ব্যাপকতায় উন্নীত করেছিল।
কিন্তু বর্তমানে সেই গৌরবোজ্জ্বল রেশম শিল্পীরা চরম দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কারিগরদের
বর্তমানে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে মুর্শিদাবাদের রেশম শিল্পীদের দৈন্যদশা চরমে। যে সিল্কের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, সেই রেশম কারিগরদের আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
কম পারিশ্রমিক: এক কারিগরের আক্ষেপ—একটি সিল্ক শাড়ি তৈরি করতে দু’জন কারিগরের দু’দিন সময় লাগে, যার সম্মিলিত মজুরি হিসেবে তাঁরা পান মাত্র ২৫০ টাকা।
উদাসীনতা: কারিগরদের জন্য যেমন কিছু ভাবা হয়নি, তেমনই বিশ্ববাজারে বাংলার এই শিল্পকে ধরে রাখতেও চোখে পড়েনি সরকারি বা প্রশাসনিক উদ্যোগ।
এই অনিশ্চিত পেশা থেকে বহু শিল্পী মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন। যদিও ভালোবাসার টানে অনেকেই এখনও পেশা বদল করতে পারেননি, কিন্তু তাদের আগামী প্রজন্ম আদৌ কতদিন এই পেশাকে ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে নিজেরাই সন্দিহান। প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং পরিশ্রমের মূল্য নগন্য হওয়ায় আজ ঐতিহ্যবাহী মুর্শিদাবাদ সিল্ক নিজের অস্তিত্ব সংকটে লিপ্ত।