রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ২৪-২৭ ঘণ্টার অতি-সংক্ষিপ্ত ভারত সফর শুধু একটি সাধারণ কূটনৈতিক যাত্রা নয়, বরং এটিকে দুই দেশের সম্পর্কের আগামী দশকের রোডম্যাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, পুতিনের এই সফর অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে—প্রতিটি মিনিটের এজেন্ডা স্থির, প্রতিটি বৈঠকের কৌশলগত তাৎপর্য গভীর।
শীর্ষস্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে, পুতিন তাঁর এই বিরল ‘পাওয়ার ভিজিট’-এ মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০টি আন্তঃসরকারি চুক্তি, ১৫টিরও বেশি বড় ব্যবসায়িক MoU, ২০৩০ সালের রোডম্যাপ এবং বেশ কয়েকটি নতুন অংশীদারিত্বে সিলমোহর দিতে পারেন।
১. রুদ্ধদ্বার ‘সীমাবদ্ধ বৈঠক’: যেখানে নীতি নির্ধারিত হবে
পুতিন ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দিল্লি পৌঁছেই সরাসরি এমন একটি বৈঠকে যোগ দেবেন, যাকে বলা হচ্ছে ‘সীমাবদ্ধ বৈঠক’ (Restricted Meeting)। এই অত্যন্ত সংবেদনশীল বৈঠকে মাত্র তিনজন থাকবেন:
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
NSA অজিত ডোভাল
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
অর্থাৎ কোনও প্রতিনিধি দল বা ক্যামেরা ছাড়াই এই রুদ্ধদ্বার আলোচনা হবে। সূত্র অনুযায়ী, এই বৈঠকেই “নীতি নির্ধারিত হবে” এবং এটিকে সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি মনে করা হচ্ছে। এরপর লোক কল্যাণ মার্গে মোদীর ব্যক্তিগত নৈশভোজ সম্পর্কের গভীরতা এবং দুই নেতার মধ্যে বিশ্বাসের উপর জোর দিচ্ছে।
২. গার্ড অফ অনার ও রাজঘাট: ‘মেসেজিং ডিপ্লোমেসি’
পরদিন সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অফ অনার এবং রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানানো শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়। কূটনীতিতে এই সূচিকে সম্পর্কের উষ্ণতা এবং সম্মানের ইঙ্গিতবাহী “মেসেজিং ডিপ্লোমেসি” হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৩. হায়দ্রাবাদ হাউসে বড় অর্থনৈতিক ডিল
হায়দ্রাবাদ হাউস হবে এই সফরের কেন্দ্রীয় স্থান। এখানে তিনটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। সবচেয়ে বড় ঘোষণাগুলি আসবে যেখানে সীলমোহর পড়তে পারে:
ভারত-রাশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা রোডম্যাপ ২০৩০
১০টি আন্তঃসরকারি চুক্তি: ভারতীয় ও রাশিয়ান নাগরিকদের পারস্পরিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত চুক্তি এবং অবৈধ অভিবাসন মোকাবিলার কাঠামো।
তরল রকেট ইঞ্জিন উৎপাদনের উপর বড় MoU
১৫টিরও বেশি বাণিজ্যিক MoU
এরপর মোদী পুতিনের সম্মানে একটি সরকারি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করবেন।
৪. ভারতের ‘বিগ ক্যাট ইনিশিয়েটিভ’-এ রাশিয়া
সফরের অন্যতম আকর্ষণীয় কূটনৈতিক জয় হলো—রাশিয়ার ইন্ডিয়ান বিগ ক্যাট অ্যালায়েন্সে যোগদান। বাঘ, সিংহ ও চিতাবাঘের সুরক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই বৈশ্বিক প্রকল্পে রাশিয়ার অংশগ্রহণ এক বড় বার্তা। এছাড়াও, পুতিন RT ইন্ডিয়ার লঞ্চ এবং রাশিয়া-ভারত বিজনেস ফোরামে অংশ নেবেন, যা মিডিয়া ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দরজা খুলবে।
৫. হেভিওয়েট প্রতিনিধি দল: নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত
পুতিনের সঙ্গে আসা প্রতিনিধি দলটি অত্যন্ত শক্তিশালী: নয়জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী, সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর, রোজনেফট, রসকসমস, রসাটম, Sberbank, VTB সহ বেশ কয়েকটি সংস্থার প্রধান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী লাভরভ না এলেও এত বড় প্রতিনিধি দলের উপস্থিতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে—রাশিয়া ভারতের সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে চায়। এই অতি-সংক্ষিপ্ত সফরটি আগামী দিনে বিশ্ব মঞ্চে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করতে চলেছে।