দেশের বিচারব্যবস্থার ভিত্তি নাড়িয়ে দেওয়া এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা (Suo Motu Case) গ্রহণ করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ (Digital Arrest) নামক এই সংগঠিত অপরাধচক্রের শিকার হয়েছেন পাঞ্জাবের অম্বালা জেলার এক প্রবীণ দম্পতি, যাঁরা মাত্র ২৩ দিনের মধ্যে প্রতারকদের হাতে খোয়ালেন ১ কোটি টাকারও বেশি।
শুক্রবার বিচারপতি সূর্য কান্ত ও জয়মাল্য বাগচি-র বেঞ্চ এই মামলার শুনানিতে মন্তব্য করে, “সুপ্রিম কোর্ট বা হাই কোর্টের নাম, সিলমোহর এবং বিচারিক কর্তৃত্ব জালভাবে ব্যবহার করা নিতান্তই এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। এটি আমাদের বিচারব্যবস্থার মর্যাদার উপর সরাসরি আঘাত।”
কীভাবে হলো এই ভয়ঙ্কর প্রতারণা?
প্রবীণ দম্পতি আদালতে একটি চিঠির মাধ্যমে অভিযোগ জানান। তাঁদের দাবি, গত ৩ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এর মধ্যে প্রতারকরা ফোন, ইমেল ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে নিজেদের সিবিআই, ইডি, আয়কর দফতর এবং বিচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়।
প্রতারকরা জানায়, দম্পতির নামে জাল আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হতে পারে। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে তারা সুপ্রিম কোর্টের নাম ও লোগো ব্যবহার করে জাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ভুয়ো সম্পত্তি বাজেয়াপ্তি আদেশ এবং বিচারপতির জাল সই-সহ নজরদারি নির্দেশ পাঠায়। এই মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে একাধিক কিস্তিতে ওই দম্পতির কাছ থেকে ১ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্ট কেন স্বতঃপ্রণোদিত?
আদালতের মতে, এটি নিছক ‘সাধারণ প্রতারণা বা সাইবার অপরাধ’ নয়, বরং বিচারব্যবস্থার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়া এক গুরুতর অপরাধ। বিচারপতির বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ করে, “যখন অপরাধীরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ঠকাতে পারে, তখন তা কেবল ব্যক্তি নয়—পুরো বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
যেহেতু প্রতারকরা একাধিক ভুয়ো আদেশ তৈরি করেছে, যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের নাম সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে, তাই আদালত এটিকে রাজ্য পুলিশের তদন্তের চেয়েও গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখছে।
কেন্দ্রীয় সংস্থাদের যৌথ পদক্ষেপের নির্দেশ
এই সংগঠিত প্রতারণার মোকাবিলায় কেবল রাজ্য নয়, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকেও যৌথভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে স্পষ্ট করেছে আদালত। বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে:
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব, সিবিআই পরিচালক, হরিয়ানা স্বরাষ্ট্রসচিব এবং অম্বালা সাইবারক্রাইম সুপারিনটেনডেন্ট-কে নোটিশ পাঠাতে হবে।
ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধের এই জাতীয় প্রবণতা মোকাবিলায় অ্যাটর্নি জেনারেল-এর সহায়তা চেয়েছে আদালত।
অম্বালা সাইবারক্রাইম সেলকে তদন্তের অগ্রগতির উপর একটি ‘স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ জমা দিতে বলা হয়েছে।
ইতিমধ্যে অম্বালা সাইবারক্রাইম সেলে দুটি এফআইআর দায়ের হয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এটি কোনও একক প্রতারণা নয়—বরং এক সংগঠিত অপরাধচক্রের অংশ, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবীণ নাগরিকদের টার্গেট করছে।
নাগরিকদের জন্য সুপ্রিম সতর্কবার্তা
আদালত এই ঘটনায় সমস্ত নাগরিকদের সতর্ক থাকতে আহ্বান জানিয়েছে। বেঞ্চ স্পষ্ট করে জানিয়েছে:
সতর্কতা: ডিজিটাল যুগে সরকারি সংস্থা বা আদালত কখনও ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপে গ্রেপ্তারি বা সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ পাঠায় না।
করণীয়: এমন কোনও বার্তা এলে তা অবিলম্বে সাইবার হেল্পলাইন নম্বর ১৯৩০ বা স্থানীয় থানায় জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সাইবার প্রতারণার বিরুদ্ধে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টের একটি নতুন নজির তৈরি করেছে। দীপাবলি ছুটির পরপরই এই মামলার পরবর্তী শুনানি নির্ধারিত হয়েছে।