চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) বাজার থেকে আরও প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অর্থ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই নতুন ঋণের পর চলতি বছরে রাজ্যের মোট বাজারঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকায়। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, অর্থবর্ষের শেষে এই মোট ঋণ এক লক্ষ কোটি টাকা ছুঁতে পারে।
এই বৃহৎ ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে রাজ্যে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর।
‘অন্ধকার ভবিষ্যতের’ ইঙ্গিত: বিজেপির কটাক্ষ
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এই ঋণ গ্রহণকে ‘অন্ধকার ভবিষ্যতের’ ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে। তাদের অভিযোগ, সরকার মূলত বাজারঋণ নিয়ে সাধারণ ব্যয়, ভাতা এবং ভোট-উদ্দেশ্যমূলক জনমুখী প্রকল্প চালাচ্ছে।
বিজেপি বিধায়ক অরূপ দাস সরাসরি বলেন,
“ঋণ নেওয়ার সময় উৎপাদনক্ষম কাজে অর্থ ব্যবহার না হলে, আগামী দিনে তা রাজ্যের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। শুধু ভাতা, খেলা বা মেলার জন্য ঋণ নেওয়া অর্থ রাজ্যের অর্থনীতিকে কোমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
‘কেন্দ্র ন্যায্য পাওনা আটকেছে’: তৃণমূলের যুক্তি
অন্যদিকে, শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, কেন্দ্র সরকার নানা খাতের ন্যায্য অর্থ যথাসময়ে না দেওয়ায় রাজ্যকে বাধ্য হয়ে নিজস্ব উদ্যোগে প্রকল্প চালাতে হচ্ছে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন,
“কেন্দ্র আমাদের ন্যায্য পাওনা আটকে রেখেছে। তবুও আমরা নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকেই ঋণ নিচ্ছি, তাই রাজ্যের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। জনগণের উন্নয়নই আমাদের অগ্রাধিকার।”
নিজস্ব ব্যয় বাড়ার কারণ: ‘বাংলার বাড়ি’ থেকে পাড়ার সমাধান
আসলে, নতুন প্রকল্প চালু এবং কেন্দ্রীয় অনুদান সময়মতো না আসায় রাজ্যের নিজস্ব ব্যয় অনেকটাই বেড়ে গেছে।
বাংলার বাড়ি: প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় তহবিল না পাওয়ায় রাজ্য নিজস্ব উদ্যোগে ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্প চালু করেছে, যার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
অন্যান্য খরচ: এছাড়াও, ২১ লক্ষ শ্রমিকের বকেয়া মজুরি পরিশোধ এবং নতুন কর্মসূচি ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’—প্রতি বুথে ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দে মোট ব্যয় প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা, যা আর্থিক চাপ আরও বাড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন?
ঋণের পরিমাণ নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও, অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মতে, কেবল ঋণের সংখ্যা দেখে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা বোঝা যায় না। তাঁর যুক্তি, ঋণের পরিমাণ বোঝার আগে রাজ্যের জিডিপি বা মোট উৎপাদনের সঙ্গে এর অনুপাত দেখা জরুরি। তিনি মনে করেন, “রাজ্যের আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সেই তুলনায় ঋণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য মাত্রায় রয়েছে।”
তবে, বিগত অর্থবর্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে রাজ্যের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ৬.৩৩ লাখ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ সালে তা ৮ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা নিয়ে বিরোধীরা রাজ্যের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি দেখছেন। যদিও শাসকদল ও অর্থনীতিবিদরা আশ্বাস দিচ্ছেন, ঋণ নেওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, এবং ব্যয় সবসময় রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যেই করা হচ্ছে।