আউশগ্রাম (পূর্ব বর্ধমান): ইন্টারনেটের দাপটে যখন প্রাচীন লোকশিল্প পুতুল নাচ হারিয়ে যেতে বসেছে, ঠিক তখনই আউশগ্রামের জঙ্গলমহল ফিরে পেল বহু শতাব্দীর সেই ঐতিহ্য। কাঁটাতার, সীমানা এবং ভৌগোলিক দূরত্বকে তুচ্ছ করে ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের দুই ভিন্ন সংস্কৃতি—বিখ্যাত ‘ওয়ায়াং পোতেহি’ এবং আদিবাসী সমাজের ঐতিহ্যবাহী ‘চদর-বদর’ পুতুলনাচের হলো এক অসাধারণ মেলবন্ধন।
বুধবার সন্ধ্যায় আউশগ্রামের মাঠে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন এই আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সাক্ষী হতে। বিদেশের শিল্পীরা ভারতে এসে দেখালেন তাঁদের সুপরিচিত ইন্দোনেশিয়ান পুতুলনাচ ওয়ায়াং পোতেহি। আর দর্শকদের প্রধান আকর্ষণ ছিল ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের শতাব্দী প্রাচীন চদর-বদর পুতুল নাচ। দুই দেশের আবেগ, ইতিহাস ও বিশ্বাস যেন এক সূক্ষ্ম সুতোয় গাঁথা হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
ইন্দোনেশিয়ার পুতুল নাচ দলের প্রধান টনি হারসনো তাঁর আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, “আমি খুবই খুশি। কারণ এই এলাকার এত মানুষ আমাদের অনুষ্ঠান দেখলেন। এখানকার মানুষ বন্ধুর মতো আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন। ভারতে এসে আমরা খুবই খুশি।”
একটি নাট্য সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মানুষের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে এর আগে কখনও বিদেশি পুতুল নাচ দেখেননি, তাই তাঁদের মধ্যে ছিল এক আলাদা উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাস।
অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সংস্থার তরফে অমিতাভ ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের সংস্থা বহুবছর ধরে পারম্পরিক লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে দেশ জুড়ে। শিল্পীদের একটা সরাসরি বাজার পাওয়ার খুব দরকার। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান খুবই প্রয়োজন, তাহলে তাঁদের সম্মান বাড়ে।” তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন, “আমি চাই ইন্দোনেশিয়ার পুতুলের সঙ্গে এখানকার চদর-বদর একসঙ্গে মিলিত হয়ে কিছু করুক। আমার আশা চদর-বদর হয়তো কোনো না কোনো দিন বিদেশে যাবে।”
চদর-বদর পুতুলনাচের ইতিহাস: ‘চদর’ মানে চাদর, আর ‘বদর’ বা ‘বাঁধনি’ অর্থাৎ বাঁধা। একটি কাপড়ের ভিতরে তৈরি হয় নাচের কাঠামো। ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা পুতুলগুলি বেল, জাম বা শিরিষ কাঠে তৈরি করা হয়। ধামসা, মাদল, হারমোনিয়ামের সুরে আদিবাসী গান গেয়ে যখন পুতুলগুলি ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে, তখন তাদের জীবন্ত মনে হয়। দুঃখের বিষয়, এই প্রাচীন লোকশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।
আউশগ্রামের মানুষ এমন এক মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যার সাক্ষী হলেন, যা আগামী বহু বছর ধরে মনে রাখার মতো। দুই দেশের সংস্কৃতির এই অনুষ্ঠান শুধু বিনোদন নয়, এ যেন দুই জনগোষ্ঠীর আত্মার সংযোগ।