শ্বেতী রোগ: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

আমাদের মধ্যে অনেকেই ধবল বা শ্বেতী রোগে ভোগেন। ত্বকের স্বাভাবিক রং যখন থাকে না এবং ত্বকের একটি অস্বাভাবিক রং দেখতে পাই, তখন তাকে শ্বেতী বা ধবল রোগ বলা হয়।

ত্বকে মেলানোসাইট নামে এক ধরনের কোষ আছে যা মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ উৎপাদন করে এবং এই মেলানিনের কারণেই আমরা ত্বকের স্বাভাবিক রং দেখতে পাই। যখন এই মেলানোসাইট রোগাক্রান্ত হয়, সংখ্যায় কমে যায় অথবা মরে যায়, তখন মেলানিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং ওই নির্দিষ্ট স্থানে সাদা দাগ পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের ডায়বেটিস আছে কিংবা থাইরয়েডের রোগ থাইরোডাইটিস আছে তাদের শ্বেতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়াও, বিশেষ এক জাতের রক্তশূন্যতা থেকেও এই রোগ হতে পারে। তবে আশার কথা হলো, শ্বেতী কোনো ছোঁয়াচে বা প্রাণঘাতী রোগ নয়।

শ্বেতী রোগ নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে। বিজ্ঞানীরা এখনও এই রোগের নির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নন। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত।

শ্বেতী রোগের কারণ:

যদিও শ্বেতীরোগের নির্দিষ্ট কোন কারণ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি, তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ আলোচনা করা যাক:

বংশগত কারণ: কারো কারো ক্ষেত্রে বংশানুক্রমে এই রোগ হতে পারে। এমনকি কয়েক প্রজন্ম পরেও এই রোগ দেখা যেতে পারে।
রাসায়নিক পদার্থের প্রতিক্রিয়া: প্রসাধনী সামগ্রীতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক বা সিন্থেটিক জাতীয় উপাদানের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার ফলে শ্বেতী হতে পারে।
শারীরিক আঘাত: অতিরিক্ত আঁটসাঁট চশমার ফ্রেমের কারণে নাকের দু’পাশে বা কানের কাছে সাদা দাগ দেখা দিতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সূর্যের তেজস্ক্রিয়তা ও মানসিক চাপ: অতিরিক্ত রোদে ত্বক পুড়ে যাওয়া অথবা দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ থেকেও শ্বেতী হতে পারে।
অন্যান্য কারণ: অনেক ক্ষেত্রে কপালে ব্যবহৃত সিন্থেটিক টিপ থেকেও শ্বেতীর শুরু হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিক বা রাবারের জুতা, ঘড়ি ইত্যাদি ব্যবহারের ফলেও শ্বেতী বা অন্যান্য চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ:

শ্বেতী বা ধবল রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখে সহজেই এই রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো:

ত্বকের উপর সাদা দাগের উপস্থিতি।
কম বয়সে মাথার চুল, চোখের পাপড়ি, ভ্রু অথবা দাড়ি সাদা বা ধূসর হয়ে যাওয়া।
মুখের ভিতরের ঝিল্লি (mucous membranes) বর্ণহীন হয়ে যাওয়া।
চোখের ভেতরের অংশে রঙের পরিবর্তন বা বর্ণহীনতা দেখা দেওয়া।
চিকিৎসা:

শ্বেতী রোগের চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি পুরোপুরি নাও সারতে পারে। তবে সাধারণভাবে প্রায় ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। শ্বেতীর চিকিৎসায় ধৈর্য ধরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা জরুরি।

দেহের লোমশ অংশের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে বেশি সফল হয়। কিন্তু যেসব অংশে লোম থাকে না, যেমন আঙুল, ঠোঁট ইত্যাদির চিকিৎসায় বেশি সময় লাগতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে রোগী নিজে থেকেই সেরেও যেতে পারে।

সঠিক চিকিৎসার জন্য অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মলম ও ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব চিকিৎসা পদ্ধতি সবার জন্য সমান ফলদায়ক নয়। রোগীর বয়স, রোগের স্থান এবং কতটা অংশ জুড়ে রোগটি ছড়িয়েছে তার উপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। শ্বেতী চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেশেই পাওয়া যায়।

করণীয়:

শ্বেতী রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি:

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে তা দূর করতে হবে।
দুধ, ছানা, মাখন, স্নেহজাতীয় ও পুষ্টিকর খাবার এবং ফলের রস বেশি করে খেতে হবে।
নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
অতিরিক্ত টাইট পোশাক পরিহার করতে হবে যা ত্বকে দাগ সৃষ্টি করতে পারে এবং রক্ত সঞ্চালনে বাধা দেয়।
ত্বকে চুলকানি হলে তা এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ আঘাতের ফলে নতুন করে সাদা দাগ দেখা দিতে পারে।
প্লাস্টিক ও রাবারের তৈরি জুতা এবং অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করা এড়িয়ে চলা উচিত।
প্লাস্টিকের অলঙ্কার ও ত্বকের উপর স্টিকার ব্যবহার করা উচিত নয়।
শ্বেতী রোগ নিয়ে অযথা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy