‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’—ডায়লগটি মিঠুন চক্রবর্তীর (Mithun Chakraborty) হলেও, চরিত্রটি ছিল বাস্তব। তিনি ছিলেন উত্তর কলকাতার কিংবদন্তি কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘ফাটাকেষ্ট’ নামে। আজ যখন বাংলার ঘরে ঘরে আলোর উৎসব, তখন প্রদীপের নিচের অন্ধকার থেকে আলো ছড়ানো এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডনের কালীপুজোর (Kali Puja) ইতিহাস আজও চর্চার কেন্দ্রে।
ফুটপাত থেকে শুরু কালীপুজো:
সময়টা স্বাধীনতার ৮-৯ বছর আগের। ঠনঠনিয়ার কালীপুজোর আলো যে ফুটপাতের কোণে পৌঁছাতো না, সেখানেই এক ছোট্ট ছেলে স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পায় ১৯৫৫ সালে। উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট লাগোয়া গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের সেই কালীপুজো বন্ধুদের মনোমালিন্য হওয়ায় সরে আসে সীতারাম স্ট্রিটের রাস্তায়। আর সেই ছেলেটিই শরীরচর্চা ও দাপটে হয়ে ওঠেন এলাকার সম্রাট, কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। ছুরির ডুয়েলে ক্ষতবিক্ষত হয়েও হাল না ছেড়ে ফিরে আসায় তিনি পেয়ে যান ‘ফাটাকেষ্ট’ উপাধি।
তারকাদের মিলনক্ষেত্র:
ফাটাকেষ্টর কালীপুজো তখন শুধু পুজো ছিল না, তা ছিল উত্তর কলকাতার এক বার্ষিক ইভেন্ট। যাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা কলকাতার বহু মানুষের ছিল না, সেই ডন এক ডাকে দেশের সবচেয়ে বড় তারকাদের নিয়ে আসতেন তাঁর পুজোর মাচা শো’য়ে।
বলিউডের সুপারস্টার: ক্লাবঘরের মাচা শো’য়ে হাজির হয়েছেন রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, মালা সিনহা এবং আশা ভোঁসলে। ১৯৭৩ সালে ‘নমকহারাম’ হিট করার সময় অমিতাভ বচ্চন বিগ-বি হওয়ার আগেই সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের ছোট্ট মঞ্চে এসে ডায়লগ ছুড়েছিলেন। অমিতাভের উপহার দেওয়া একটি হিরে বসানো নাকছাবি পরে চুরি হয়ে গেলেও ফাটাকেষ্টর দলবল তা পুনরুদ্ধার করে।
সুরের কিংবদন্তি: ১৯৮২ সালে এক কালো গাড়িতে চেপে এসেছিলেন আশা ভোঁসলে, কিন্তু চমক ছিল তাঁর সঙ্গে থাকা স্বয়ং আরডি বর্মণ (R D Burman)। এই দুই কিংবদন্তির আগমন সেই বছরের পুজোর রমরমা বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ।
মহানায়ক উত্তম কুমার: উত্তম কুমারও মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত প্রতি বছর একটানা এই দীপান্বিতা কালীপুজোয় আসতেন। জনশ্রুতি, প্রণাম সেরে মঞ্চে কিছু না কিছু বলে যেতেন তিনি।
যোগীগুরুকে কাঁধে বহন:
নকশাল আমলে যখন কলকাতা টালমাটাল, তখন একবার যোগীগুরু ওঙ্কারনাথ কাশী থেকে কলকাতায় আসেন। দীপান্বিতার মুহূর্তে মায়ের দর্শন করতে চাইলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ কেষ্ট নিজেই যদুনাথ বোস লেন থেকে গুরুদেবকে নিজের কাঁধে করে মায়ের মণ্ডপে নিয়ে গিয়েছিলেন। নকশাল আমলের সেই কলকাতা শহরে এই দৃশ্য ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
১৯৯২ সালে ফাটাকেষ্ট প্রয়াত হলেও, আজও সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের দশ ফুটের গলি জুড়ে ঘননীল বরণ শ্যামা মা আসেন দীপান্বিতা তিথিতে। বাংলার প্রথম ডনের এই গরিমা আজও ‘ফাটাকেষ্টর পুজো’ নামেই বহাল তবিয়তে চলছে।