বাংলার নদী-নালা, খাল-বিলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৌকার ইতিহাস। সেই ইতিহাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ‘ছোট্’ নৌকা। একসময় বাংলার নদীপথে দাপিয়ে বেড়াত এই ছোট্ নৌকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঐতিহ্যবাহী নৌকা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে বাংলার এই বিপন্ন সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম। হাওড়ার শ্যামপুরের এই ঐতিহ্যবাহী নৌকার সব তথ্য ও নির্মাণশৈলী এখন সংরক্ষিত হবে ব্রিটেনে।
ছোট্ নৌকার ইতিহাস:
‘ছোট্’ শব্দের অর্থ হল ছুটে চলা। ছুঁচলো মুখের এই নৌকা সমুদ্রের জল কেটে দ্রুতগতিতে ছুটে চলতে পারে বলেই এর এমন নাম। বাংলার নদীপথে একসময় মাছ ধরা থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার হত এই নৌকা। হাওড়ার শ্যামপুর, যেখানে রূপনারায়ণ নদ গঙ্গায় মিশেছে, সেখানকার গ্রামে গ্রামে তৈরি হত এই ছোট্ নৌকা। কিন্তু নদীর চর জমে যাওয়া এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই নৌকার ব্যবহার এখন প্রায় বিলুপ্ত।
ব্রিটিশ গবেষণায় সংরক্ষণ:
বাংলার এই প্রায় বিলুপ্ত নৌকাকে সংরক্ষণ করতে এগিয়ে এসেছে ব্রিটেন। ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্প ‘এনডেঞ্জার্ড মেটেরিয়াল নলেজ’ বা ‘বিপন্ন উপাদানের জ্ঞান’-এর অধীনে সংরক্ষিত হবে ছোট্ নৌকার সব তথ্য ও নির্মাণকৌশল। এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন কুপার, ব্রিটেন নিবাসী পুরাতত্ত্ব গবেষক জিশান আলি এবং হাওড়ার নৌ শিল্প গবেষক স্বরূপ ভট্টাচার্য।
নৌকা নির্মাণে পঞ্চানন মণ্ডল:
শ্যামপুরের নৌকা নির্মাতা পঞ্চানন মণ্ডল এই প্রকল্পের অন্যতম কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় ৩০ বছর পর তিনি আবারও হাত লাগিয়েছেন ছোট্ নৌকা তৈরির কাজে। তাঁর চার পুত্রও এই কাজে সহযোগিতা করছেন। পঞ্চাননবাবু একটি ৩৫ ফুট লম্বা, ৯ ফুট চওড়া এবং ৬ ফুট গভীর ছোট্ নৌকা তৈরি করছেন। আগে শ্যামপুরের বাড়ি বাড়িতে ছোট্ নৌকা তৈরি হত, কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে গেছে। পঞ্চাননবাবু বলেন, “জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ফের ছোট্ তৈরি করতে পারলাম। এটাই আমার পরম প্রাপ্তি।”
বিশ্বের দরবারে বাংলার সংস্কৃতি:
ছোট্ নৌকা নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়া ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছে এবং সমস্ত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। এই তথ্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হবে। এছাড়া, আগামী দিনে এই নৌকাটি মেরিটাইম মিউজিয়ামে রাখা হবে বলে জানা গেছে। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এই নৌকা নির্মাণ সংস্কৃতি এভাবেই পৌঁছে গেল বিশ্বের দরবারে।
উপসংহার:
বাংলার নদী ও নৌকার সংস্কৃতি শুধু স্থানীয় ইতিহাসই নয়, এটি বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের এই উদ্যোগ বাংলার বিপন্ন সংস্কৃতিকে নতুন প্রাণ দেবে। ছোট্ নৌকার মাধ্যমে বাংলার গ্রামীণ জীবন ও শিল্পকৌশল বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যাবে। এই উদ্যোগ শুধু অতীতকে স্মরণ করাই নয়, ভবিষ্যতের জন্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে আবারও জীবন্ত করে তোলার এই প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।