নাগরিক জীবনে গ্যাস ছাড়া একটি দিনও অকল্পনীয়। আমাদের রান্না-খাওয়ার সিংহভাগই নির্ভর করে এই গ্যাসের ওপর। কোনো এলাকায় একদিন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকলে প্রায় সব বাড়িতেই রান্না বন্ধ থাকে। তখন ভরসা করতে হয় দোকানের খাবারের ওপর। এই গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইনের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় গ্যাস সিলিন্ডারও। গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও গ্যাস দুর্ঘটনার ভয় সবসময় থেকেই যায়। সামান্য অসাবধানতার কারণে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এ ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। তাই সবার আগে সচেতন ও সতর্ক থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
গ্যাসের পাইপ লিক হলে যেভাবে বুঝবেন:
গ্যাসের পাইপ লিক হলে তা বোঝার একমাত্র উপায় হলো গন্ধ। কারণ গ্যাস খালি চোখে দেখা যায় না। পাইপ থেকে গ্যাস লিক হলে চারপাশে এর তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যেকোনো জায়গায় লিক হলেই গন্ধ দ্রুত ছড়িয়ে যায়। তাই গ্যাসের গন্ধ পেলেই বুঝে নেবেন কোথাও লিক হয়েছে এবং দ্রুত সতর্ক হোন।
লিক হলে কী করবেন:
গ্যাসের গন্ধ নাকে লাগলে দ্রুত তার উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। লিক হওয়া স্থানটি খুঁজে পেলে সেখানে প্রথমে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখুন। এরপর দ্রুত স্থানীয় গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থাকে খবর দিন। কোনোভাবেই গ্যাস লিক হওয়া স্থানের আশেপাশে আগুন জ্বালাবেন না বা কোনো দাহ্য পদার্থ রাখবেন না। আশেপাশে দাহ্য কিছু থাকলে তা দ্রুত সরিয়ে ফেলুন। ঘরের মেইন ইলেকট্রিক সুইচ বন্ধ করে দিন এবং একইসঙ্গে দরজা-জানালা খুলে দিন যাতে গ্যাস বেরিয়ে যেতে পারে।
গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে করণীয়:
যেসব বাড়িতে এলপিজি বা সিলিন্ডারের গ্যাসের মাধ্যমে রান্না করা হয়, সেখানেও সমান সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও কিন্তু কম নয়। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়াতে সবসময় সতর্ক থাকুন। বিভিন্ন কারণে সিলিন্ডারের গ্যাস লিক হতে পারে, যেমন হোস পাইপ, রেগুলেটর বা গ্যাস ভাল্বের সমস্যা। এই গ্যাস নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করলে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ ও ত্যাগে বাধা দেয়। এতে দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে এবং শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যার ফলে ভুক্তভোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।
সিলিন্ডারের গ্যাস খুব বেশি চাপে তরল করে ভরা হয়। ফলে এর বিস্ফোরণ ঘটলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিস্ফোরণের ফলে শক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে। এই শক ওয়েভ শরীরের যে অংশে লাগে, সেই অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এ ধরনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস। এটি আশেপাশে থাকা সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।
সিলিন্ডারের গ্যাস লিক হলে কী করবেন?
পাইপলাইনের গ্যাসের মতোই সিলিন্ডারের গ্যাস লিক হলেও গন্ধই একমাত্র বোঝার উপায়। তাই গ্যাসের গন্ধ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মেইন ইলেকট্রিক সুইচ বন্ধ করে দিন। কোনোভাবেই আগুন জ্বালাবেন না। ঘরের জানালা-দরজা খুলে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। দ্রুত সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করে সেফটি ক্যাপ লাগান।
সিলিন্ডারের গ্যাস লিক হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করুন:
দুর্ঘটনা এড়াতে মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখুন সিলিন্ডারের গ্যাস লিক হচ্ছে কি না। প্রথমে একটি পাত্রে জল নিয়ে তাতে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে ফেনা তৈরি করুন। এরপর এই ফেনা হোস পাইপ, ভাল্ব, রেগুলেটর ইত্যাদিতে লাগান। যদি কোথাও সাবান-জলের ফোটা বড় হতে থাকে, তবে বুঝবেন সেই স্থানে গ্যাস লিক হচ্ছে। তখন দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
বিস্ফোরণ থেকে এড়াতে যা করবেন:
গ্যাস দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে রান্নার পরই চুলা বন্ধ করে রাখুন। কোনোভাবেই চুলা জ্বালিয়ে রাখবেন না।
রান্নাঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
গ্যাসের গন্ধ তীব্র হওয়াতে সহজেই নাকে এসে লাগে, তাই এ ধরনের গন্ধ পেলেই সতর্ক হোন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
উচ্চচাপ বা তাপের স্থানে সিলিন্ডার রাখবেন না।
চুলায় রান্না বসিয়ে অন্য কাজে ডুবে যাবেন না। রান্নার সময় চুলার আশেপাশেই থাকুন, কারণ খাবার পুড়েও আগুন ধরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হতে পারে।
সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে করণীয়:
যদি কোনো কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে যায়, তবে যত দ্রুত সম্ভব আহতদের খোলা স্থানে নিয়ে যান, যেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে। অনেক সময় তাদের অক্সিজেনের প্রয়োজন হতে পারে, তাই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিস্ফোরণের কারণে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেখানে অন্তত বিশ মিনিট ধরে ঠান্ডা জল ঢালতে থাকুন। গ্যাস কাপড়ে লাগলে দ্রুত কাপড় পাল্টে ফেলুন এবং চোখে জলের ঝাপটা দিন। আগুনের কারণে গায়ে ফোসকা পড়লে তা টেনে না তুলে দ্রুত হাসপাতালে যান।
সিলিন্ডারে আগুন ধরলে নেভাবেন যেভাবে:
সিলিন্ডারে আগুন ধরে গেলে আতঙ্কিত না হয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করুন। প্রথমে একটি মোটা সুতির কাপড় নিয়ে সিলিন্ডারটি ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখবেন আগুন যেন আপনার শরীরে না লাগে। এরপর দ্রুত রেগুলেটর ঘুরিয়ে সিলিন্ডার বন্ধ করে দিন। এতে আগুন নিভে যাবে।
গ্যাসের ব্যবহার আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলেছে, তবে সামান্য অসাবধানতা কেড়ে নিতে পারে মূল্যবান জীবন। তাই সবসময় সতর্ক থাকুন এবং গ্যাস ব্যবহারের নিয়মাবলী মেনে চলুন। কোনো রকম অস্বাভাবিকতা দেখলে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।