বিশ্বজুড়ে প্রজনন হার আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যা পূর্বের অনুমানকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চীনে জন্মহার ইতিমধ্যেই সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। শুধু চীন নয়, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও জন্মের হার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত কমছে।
আগের তুলনায় মানুষ কম সন্তান নিচ্ছে এবং একই সাথে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে সন্তান না নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। কলম্বিয়ার ইসাবেল তিরিশের কোঠায় বিচ্ছেদের পর সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ‘নানকা মাদ্রেস’ নামে একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। সন্তানহীনতার এই সিদ্ধান্তের জন্য তিনি দেশে-বিদেশে সমালোচিত হন। ইসাবেল বলেন, “সবচেয়ে বেশি যে কথা শুনি তা হলো, এই সিদ্ধান্তের জন্য একদিন পস্তাবেন, আপনি স্বার্থপর। বুড়ো বয়সে কে আপনার যত্ন নেবে?”
ইসাবেলের জন্য সন্তানহীন জীবন তার ব্যক্তিগত পছন্দ হলেও, অনেকের ক্ষেত্রে এটি শারীরিক অক্ষমতার ফল। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সন্তানহীনতার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে, যা সমাজবিজ্ঞানীরা ‘সামাজিক বন্ধ্যাত্ব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা সন্তান নিতে চাইলেও তাদের সেই সক্ষমতা থাকে না, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। নরওয়েতে ২০২১ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, সর্বনিম্ন পাঁচ শতাংশ আয়ের পুরুষদের মধ্যে ৭২ শতাংশ সন্তানহীন, যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ উপার্জনকারীদের মধ্যে এই হার মাত্র ১১ শতাংশ। গত ৩০ বছরে এই ব্যবধান প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।
রবিন হ্যাডলি ত্রিশের কোঠায় বাবা হতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে নতুন সম্পর্ক গড়তে পারেননি এবং তার বন্ধু-সহকর্মীদের বাবা হতে দেখে তার মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয়। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পুরুষদের সন্তানহীনতা নিয়ে একটি বই লেখেন এবং বুঝতে পারেন যে অর্থনীতি, জীববিজ্ঞান এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কসহ নানা বিষয় প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে বার্ধক্য ও প্রজনন সংক্রান্ত আলোচনায় সন্তানহীন পুরুষদের কথা প্রায় অনুপস্থিত।
সামাজিক বন্ধ্যাত্বের বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে সন্তান ধারণের জন্য সম্পদের অভাব বা সঠিক সময়ে সঠিক সঙ্গীর অভাব। ফিনল্যান্ডের পপুলেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমাজবিজ্ঞানী আনা রটকির্চ মনে করেন, সন্তান ধারণের বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও এর একটি বড় কারণ। একসময় বিয়ে ও সন্তান ধারণকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু এখন মানুষ জীবনের অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনের পর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবে।
অধ্যাপক রটকির্চ ব্যাখ্যা করেন, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মনে করে যে সন্তান তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা যোগ করবে। ফিনল্যান্ডে দেখা গেছে, ধনী নারীরা সাধারণত ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানহীন থাকেন, অন্যদিকে নিম্ন আয়ের পুরুষদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানহীন থাকতে হয়।
পুরুষদের ক্ষেত্রে, আর্থিক অনিশ্চয়তা সন্তান নেওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা একে ‘দ্য সিলেকশন এফেক্ট’ বলেন, যেখানে নারীরা সঙ্গী বেছে নেওয়ার সময় একই বা উচ্চ সামাজিক শ্রেণীর পুরুষদের পছন্দ করেন। রবিন হ্যাডলি মনে করেন, তার ত্রিশের কোঠায় সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ ছিল।
বিশ্বের ৭০ শতাংশ দেশে নারীরা শিক্ষায় পুরুষদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যাকে ‘দ্য মেইটিং গ্যাপ’ বলছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী মার্সিয়া ইনহর্ন। ইউরোপে, অনেক পুরুষ এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিচ্ছেন না এবং তাদের নিঃসন্তান হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বেশিরভাগ দেশে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা নিয়ে তেমন তথ্য নেই, কারণ জন্ম নিবন্ধনের সময় শুধুমাত্র মায়ের প্রজননের ইতিহাস নথিভুক্ত করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষদের স্বাস্থ্য ও প্রজনন বিশেষজ্ঞ ভিনসেন্ট স্ট্রব বলেন, জন্মহার হ্রাসে পুরুষদের ভূমিকা প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। তিনি মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি পুরুষত্ব ও পুরুষদের থেকে প্রত্যাশার পরিবর্তনও এর একটি কারণ, যাকে ‘পুরুষত্বের সংকট’ বলা হচ্ছে।
স্ট্রব আরও বলেন, কম শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষদের অবস্থা আগের দশকের তুলনায় খারাপ। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে অনেক কায়িক শ্রমের কাজ মূল্য হারিয়েছে, যা কম শিক্ষিত পুরুষদের জন্য অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
ভিনসেন্ট স্ট্রব মনে করেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে প্রজননের একটি যোগসূত্র রয়েছে এবং এটি পুরুষদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মৌলিক প্রভাব ফেলতে পারে। অবিবাহিত পুরুষদের স্বাস্থ্য সাধারণত বিবাহিত বা সঙ্গীসহ পুরুষদের তুলনায় খারাপ হয়। মাদক দ্রব্যের অপব্যবহারও বিশ্বব্যাপী বেড়েছে এবং প্রজনন বয়সের পুরুষদের মধ্যে এই হার বেশি।
স্ট্রব ও হ্যাডলি মনে করেন, প্রজনন সংক্রান্ত আলোচনায় পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং পিতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা নিয়েও আলোচনা করা উচিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মাত্র এক শতাংশ পুরুষ সন্তানের দেখাশোনার জন্য কর্মজীবনে বিরতি নেয়, যেখানে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার তিনজনে একজন।
গবেষকরা মনে করেন, সন্তানহীন ব্যক্তিরাও শিশু লালন-পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাকে আচরণগত বাস্তুবিজ্ঞানীরা ‘অ্যালোপ্যারেন্টিং’ বলেন। এর মাধ্যমে দাদা-দাদী বা অন্য আত্মীয়-স্বজন শিশুদের পরিচর্যা করে।
ড. হ্যাডলি তার গবেষণায় এমন অনেক নিঃসন্তান পুরুষের কথা জেনেছেন যারা বিভিন্নভাবে শিশুদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক রটকির্চ মনে করেন, বেশিরভাগ নিঃসন্তান পুরুষই শিশুদের যত্ন নিতে সক্ষম, কিন্তু তাদের এই ভূমিকা অদৃশ্য থেকে যায়।
স্ট্রব ও হ্যাডলির মতে, পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা এবং এর সামাজিক ও মানসিক প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালো তথ্য প্রয়োজন। যতক্ষণ না এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অদৃশ্য জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো সমাধান করা কঠিন হবে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পুরুষদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়েও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৫ বছর বয়সের পর পুরুষদের শুক্রাণুর কার্যকারিতা কমতে শুরু করে, তাই পুরুষদেরও একটি জৈবিক ঘড়ি রয়েছে। অভিভাবকত্বের সংজ্ঞা সম্প্রসারণ এবং অ্যালোপ্যারেন্টিংকে স্বীকৃতি দেওয়া সামাজিক বন্ধ্যাত্ব মোকাবেলার একটি উপায় হতে পারে।