আপনার কি ঘুম থেকে উঠতেই ক্লান্ত লাগে? সারাদিন এই ক্লান্তি টেনে নিয়ে বেড়াতে হয় নিজেকে? হয়তো ভাবছেন, আরেকটু বেশি ঘুমোলেই এই ক্লান্তি কেটে যাবে। কিন্তু এই সাধারণ উপসর্গের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে গভীর শারীরিক বা মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত।
কাজের চাপ, এলোমেলো ঘুমের সময়, বা মানসিক অশান্তি—এসবই ক্লান্তির কারণ হতে পারে। আমরা সবাই কখনো না কখনো ক্লান্তি অনুভব করি। কিন্তু যদি এই ক্লান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে, তবে এটি আর শুধু ক্লান্তি নয়, বরং কোনো বড় সমস্যার সংকেত হতে পারে। গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন এমন কিছু কারণ, যা দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি ও অবসাদের জন্য দায়ী। আসুন জেনে নিই এর পেছনের কারণগুলো।
ক্লান্তির শারীরিক ও মানসিক কারণ
১. অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা
শরীরে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনের অভাব হলে অ্যানিমিয়া হয়। এটি শরীরে অক্সিজেন পরিবহনে বাধা দেয়, ফলে ক্লান্তি ও দুর্বলতা দেখা দেয়। নারীদের মধ্যে এটি বেশি প্রচলিত। গবেষকদের মতে, আয়রন, ভিটামিন বি১২ এবং ফোলেটের ঘাটতি এর প্রধান কারণ।
২. থাইরয়েড সমস্যা
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোন কমে যাওয়া), শরীরের বিপাক ক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। ফলে ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি এবং অবসাদের মতো উপসর্গ দেখা যায়।
৩. ডিপ্রেশন বা হতাশা
হতাশা কেবল মানসিক নয়, শারীরিক ক্লান্তিরও কারণ হতে পারে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শক্তি হারান এবং কোনো কাজে উৎসাহ পান না। গবেষণা বলছে, এ সময় মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা ক্লান্তি বাড়ায়।
৪. ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিসে রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হলে শক্তি কমে যায়। ইনসুলিনের সমস্যা বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া) ক্লান্তি ও দুর্বলতার কারণ হতে পারে।
৫. ঘুমের সমস্যা: ইনসোমনিয়া বা স্লিপ অ্যাপনিয়া
ঘুমের গুণগত মান কমে গেলে বা পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ক্লান্তি স্বাভাবিক। স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, যা শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে বাধা দেয়।
৬. অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ
অতিরিক্ত চিন্তা মানসিক শক্তি কেড়ে নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বেগে কর্টিসল হরমোন বেড়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ক্লান্তি ডেকে আনে।
৭. ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম (সিএফএস)
এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে তীব্র ক্লান্তি থাকে, যা বিশ্রামেও কমে না। এর সঠিক কারণ এখনও অজানা, তবে ভাইরাস বা ইমিউন সিস্টেমের সমস্যার সঙ্গে এটি যুক্ত হতে পারে।
জীবনযাত্রার অভ্যাসও দায়ী
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ভিটামিন ডি, বি কমপ্লেক্স ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব, প্রক্রিয়াজাত খাবার বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন ক্লান্তি বাড়ায়।
শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: নিয়মিত ব্যায়াম না করলে ক্লান্তি বাড়ে। ব্যায়াম শরীরে এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে শক্তি বাড়ায়।
পানিশূন্যতা: পর্যাপ্ত পানি না পান করলে শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়, ফলে ক্লান্তি দেখা দেয়।
পরিবেশগত ও সামাজিক কারণ
কাজের চাপ: অতিরিক্ত কাজ ও ভারসাম্যহীনতা শরীর ও মনকে ক্লান্ত করে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: একাকীত্ব বা সামাজিক সম্পর্কের অভাব মানসিক ক্লান্তি বাড়ায়।
কী করবেন?
এই লক্ষণগুলো যদি আপনার মধ্যে থাকে, তবে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এছাড়াও—
শাকসবজি, ফলমূল ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম করুন।
প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান।
মেডিটেশন বা যোগব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমান।
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি থাকলে রক্ত পরীক্ষা করান।
মনে রাখবেন, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি কেবল অলসতা নয়, এটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।