প্রতিদিনই একটু একটু করে বেড়ে চলেছে বয়স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলে, “২০৫০ সালে বিশ্বব্যাপি ২০০ কোটি মানুষের বয়স হবে ৬০ বা তারও বেশি।”
আবার ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ’য়ে প্রকাশিত এক গবেষণার দাবির ভিত্তিতে জানায়, এই শতকের শেষ হওয়ার আগেই আমরা একজন মানুষকে ১২০ বছর বাঁচতে দেখব।
এই দীর্ঘায়ুর সঙ্গে সমস্যাও আছে, বয়স যত বেশি, ততই বার্ধক্যজনীত অসুখও বেশি।
তবে যুক্তরাষ্টে্রর জর্জটাউন’য়ের ‘ব্রেইন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব’য়ের পরিচালক ও ‘নিউরোসায়েন্স’ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাইকেল টি. আলম্যান একই প্রতিবেদনে বলেন, “আমরা গবেষণায় কিছু বয়ষ্ক মানুষের মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে দেখেছি। বার্ধক্যে পা দেওয়ার প্রতি আমাদের দৃষ্টি বদলে দেয় এই গবেষণাগুলো। সিংহভাগ মানুষ ধারণা করেন বয়স বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। তবে মানসিক কিছু বিষয় বয়সের সঙ্গে আরও তীক্ষ্ণ হয়, যার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দীর্ঘদিন সেই মানসিক কৌশলগুলোর চর্চা।”
বয়সের ভার একজন মানুষকে কীভাবে নুইয়ে দেবে তার কোনো স্থির নিয়ম নেই। বার্ধক্য কতটা সুগম হবে সেটা মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
জীবনের শেষ বছরগুলো সুস্থতার সঙ্গে পার করার জন্য কিছু অভ্যাস বাদ দিতে হবে। অন্যথায় এই অভ্যাসগুলোই আপনাকে মাঝবয়সে বৃদ্ধ বানিয়ে দিতে পারে।
অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখা
কোনো এক ছুটির দিনে রাত জেগে টেলিভিশন দেখলেই যে স্বাস্থ্যহানি হয়ে যাবে এমনটা নয়। তবে একে অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’য়ের এক গবেষণা বলে, “মাঝবয়সের অধিকাংশ সময় টেলিভিশন দেখে পার করলে মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পায়, বৃদ্ধ বয়সে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে। কারণ অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার কারণে মস্তিষ্কের ‘গ্রে ম্যাটার’ হ্রাস পায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্নায়বিক কাজের জন্য ‘গ্রে ম্যাটার’ জরুরি।”
নিউ ইয়র্ক-প্রেসবাইটেরিয়ান/ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি আরভিং মেডিকাল সেন্টার’য়ের ‘নিউরোলজিস্ট’ প্রিয়া পালটা বলেন, “টেলিভিশন দেখা একটি অলস অভ্যাস, যা মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতা কমায়। তাই যেকোনো ধরনের অলস অভ্যাস যথাসম্ভব পরিহার করাই হবে মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।”
প্রায় সারাদিন নিষ্ক্রিয় থাকা
শারীরিক কসরত পেশি আর হাড় ভালো রাখে একথা অনেকেই জানেন। তবে অনেকেই হয়ত জানেন না যে শরীরচর্চার উপকারিতা শরীরের কোষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
‘জেএএমএ অ্যান্ড আর্কাইভস জার্নাল’য়ে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, “যারা নিজেদের অবসর সময়গুলো শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকেন তারা প্রকৃত অর্থে অলস মানুষগুলোর তুলনায় তরুণ থাকেন।”
অর্থাৎ অলস জীবনযাত্রা প্রকৃত অর্থেই একজন মানুষকে অল্প বয়সে বুড়ো বানিয়ে দেয়, বাড়ায় অকাল মৃত্যুর আশঙ্কাও।
মায়ো ক্লিনিকের ‘অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অ্যান্ড ফিজিওলজিস্ট’ ডা. মাইকেল জয়নার বলেন, “প্রতিদিন সামান্য কার্ডিও ব্যায়ামের অভ্যাস বৃদ্ধ বয়সে মস্তিষ্ক ভালো রাখার জন্য বিশাল ভূমিকা রাখতে সক্ষম। শারীরিক পরিশ্রম আর সুস্থতা যে মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতাকে ভালো রাখতে জরুরি তা আরও একবার চোখ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সামান্য ব্যায়ামের এই প্রভাব।”
অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাস
মহামারি আর লকডাউনের দিনগুলো ঘুমের অভ্যাসে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সবারই। বয়সের ভারের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার এই ঘুম ও ঘুমের শৃঙ্খলাবদ্ধ অভ্যাস।
‘স্লিপ’ নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা বলে, “মধ্যবয়সি একজন মানুষ প্রতিদিন ছয় ঘণ্টার কম আর আট ঘণ্টার বেশি ঘুমালে তার মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতা কমতে থাকে দ্রুত। প্রকৃত বয়সের তুলনায় মস্তিষ্কের বয়স বেড়ে যাওয়া সম্ভব চার থেকে সাত বছর।”
ঘুমের বদভ্যাস প্রভাব ফেলে ত্বকেও।
‘ক্লিনিকাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল ডার্মাটোলজি’ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় জানা যায়, কম ঘুমালে ত্বকের বয়স বাড়ে দ্রুত।
এই গবেষণার গবেষক, ‘স্কিন স্টাডি সেন্টার অ্যাট ইউএইচ কেস মেডিকাল সেন্টার’য়ের পরিচালক এবং কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের ‘ডার্মাটোলজি’ বিভাগের সহ-অধ্যাপক ডা. এলমা ব্রাউন বলেন, “আমাদের গবেষণাই প্রথম তুলে ধরে যে ঘুমের অভ্যাস অনিয়মিত হলে তা ত্বকের ক্ষতি করে, বয়সের ছাপ ফেলে দ্রুত। যারা কম ঘুমান তাদের ত্বক রোদপোড়া থেকে সেরে উঠতে অনেক বেশি সময় নেয়, ত্বক কুঁচকে যেতে থাকে।”
ইন্টারনেট আসক্তি
ইন্টারনেট নিঃসন্দেহে জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তবে পৃথিবীর সকল ভালো জিনিসের মতো ইন্টারনেটও অতিরিক্ত ব্যবহার ক্ষতির কারণ।
কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি যেকোনো বৈদ্যুতিক পর্দা যুক্ত যন্ত্র মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে তা থেকে নির্গত নীল আলো ক্রমাগত বার্ধক্যের দিকে ঠেলে দেয় অকালেই।
তাই যখনই সুযোগ পান ইন্টারনেটের জগত থেকে বেরিয়ে বই পড়া ও লেখালেখির অভ্যাসে মনযোগ দিন।
রেডিওলজিকাল সোসাইটি অফ আমেরিকা’র গবেষণার লেখক ড. কনস্ট্যান্টিনোস আরফানাকিস বলেন, “পড়া ও লেখার অভ্যাস মস্তিষ্কের অবকাঠামোকে সুরক্ষিত রাখে। পত্রিকা পড়া, চিঠি লেখা, পাঠাগারে সময় কাটানো, মাঠে খেলাধুলা করা ইত্যাদি সাধারণ কাজগুলো মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্য বজার রাখার জন্য খুবই জরুরি।”
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা
বর্তমান সময়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রচণ্ড দ্রুতগতির, আর সঙ্গে মানসিক চাপ তো আছেই। জীবনের কিছু ক্ষেত্রে মানসিক চাপের কারণগুলো সমাধানের চাইতে তা দূরে সরিয়ে রাখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেললে মানসিক প্রশান্তি আসবে ঠিক। তবে সমস্যার যখন কোনো শেষ নেই তখন তাকে একপাশে রেখে একটু জিরিয়ে নেওয়াই শ্রেয়।
ইয়েল ইউনিভার্সিটি’র গবেষণায় জানা যায়, ক্রমাগত মানসিক চাপ বৃদ্ধ বয়সের আগেই শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন মানুষকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিতে পারে।
এই গবেষণায় ‘ডিএনএ’য়ের সঙ্গে সম্পর্কিত এক রাসায়নিক উপাদান ‘এপিজেনেটিক’য়ের কারণে হওয়া শারীরিক পরিবর্তনের দিকে মনযোগ দেন গবেষকরা।
মোট ৪০০ জন অংশ নেয় এই গবেষণায়। এদের মধ্যে যারা প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিন পার করেন, তাদের মাঝে অকালে বয়ষ্ক ছাপ ছিল স্পষ্ট।
গবেষণার লেখক, ‘ইয়েল ডিপার্টমেন্ট সায়কায়াট্রি’র জ্যাকারি হার্ভানেক বলেন, “মানসিক চাপ মানুষকে বৃদ্ধ করে তোলে এই ধারণা আমাদের গবেষণায় আবারও প্রমাণীত হয়। তবে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এই প্রভাবকে যে বদলে দেওয়া সম্ভব সেটাও বোঝা যায় এই গবেষণা থেকে।”bs