আয়ুর্বেদ চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূল সূত্রই হচ্ছে, সুস্থ মানুষের সুস্থতা রক্ষা করা এবং রোগাক্রান্ত মানুষকে রোগমুক্ত করা। শোধন বা ডিটক্সিফিকেশনের চিকিৎসাক্ষেত্রে মূলত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এক, শমন চিকিৎসা অর্থাৎ রোগ প্রশমনের বিবিধ উপায়। দুই, শোধন চিকিৎসা অর্থাৎ রোগকে সমূলে উৎপাটন করার বিবিধ পদ্ধতি যা ডিটক্সিফিকেশন হিসেবে ধরা হয়।
এই শোধন শব্দটা সংস্কৃত শব্দ যার গূঢ়ার্থ হল ‘শুদ্ধ’ অর্থাৎ পরিষ্কার করা। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা ও অষ্টাঙ্গ হৃদয়ের মতো আয়ুর্বেদের গুরুত্বপূর্ণ মূল গ্রন্থসমূহ ছাড়াও অন্যান্য অনেক গ্রন্থে রয়েছে এই শোধন চিকিৎসার শ্রেষ্ঠতার গুণকীর্তন। আচার্য চরকের মতে, যে সকল চিকিৎসার মাধ্যমে শরীরের বিষম দোষকে সাম্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় তাই প্রকৃত চিকিৎসা। প্রখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক ও চরক সংহিতার টিকাকার চক্রপানী দত্তের মতে, রোগের সমূলে উৎপাটনের লক্ষ্যে শোধন চিকিৎসা এক অদ্বিতীয় চিকিৎসা।
কী এই শোধন চিকিৎসা
এই শোধন চিকিৎসা পাঁচ ভাগে বিভক্ত। তাই এটির আর এক নাম ‘পঞ্চকর্ম’। রোগীর রোগ, রোগের তীব্রতা, রোগীর দেহবল, দোষের প্রাবল্য ইত্যাদির উপর নির্ভর করে আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ঠিক করেন কোন ক্ষেত্রে কোন প্রকার চিকিৎসা উপযোগী হবে।
বমন চিকিৎসা
চরক মতে ‘দোষ হরণম উর্ধভাগম বমন সঙ্ককম।’অর্থাৎ শরীরের উপরিভাগ দ্বারা দূষিত দোষের অপসারণকে এককথায় ‘বমন চিকিৎসা’ বলে। এতে পাকস্থলীর দূষিত ও অপক্ক পদার্থসমুহ শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসে।
বিরেচন চিকিৎসা
দেহের বিবিধ প্রকার দূষিত আবর্জনা ও পক্কাশয়ের দূষিত পিত্তকে মলের সাথে নির্গমনকে ‘বিরেচন’ বলে।
বস্তি চিকিৎসা
এই চিকিৎসাকে শোধন চিকিৎসার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বা অর্ধ চিকিৎসা বলা হয়, যেখানে বিভিন্ন প্রকার ঔষধি দ্রব্য সহযোগে ও ক্ষেত্রবিশেষে একক স্নেহ ও তরলকে এনেমা দ্বারা প্রবেশ করিয়ে শরীরকে শুদ্ধ করা হয়।
নস্য চিকিৎসা
বিভিন্ন প্রকার ঊর্ধজত্রু গত রোগে অর্থাৎ আপার ক্লাভিকুলার ডিজিজে নস্য শ্রেষ্ট চিকিৎসা যেখানে ভেষজ সমৃদ্ধ তেল বা চূর্ণ নাকের দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে দেওয়ার বিধান রয়েছে।
রক্তমোক্ষণ
এককথায় এটি হল শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কয়েকটি উপায়ে পরিমাণ মতো রক্তকে বের করে বিভিন্ন কঠিন থেকে কঠিনতম রোগের সুচিকিৎসার পদ্ধতি।
এই চিকিৎসার শ্রেষ্ঠত্ব
দোষা কদাচিৎ ক্যুপন্তি জিতা লঙ্ঘন পাচনে।
জিতা সংশোধনৈয় তু নং তেশাং পুনরূদভব।
(চরক সংহিতা,সূত্র স্থান:১৬/২০)
অর্থাৎ লঙ্ঘন,পাচন ইত্যাদি ঔষধ প্রয়োগে শরীরের দূষিত দোষকে শমন করা গেলেও তা পুনরায় দেহে রোগ আকারে প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু শোধন চিকিৎসার ফলে শুদ্ধ হওয়া শরীরে রোগের পুনরুভাব ঘটে না। যখন রোগকে কোনওভাবেই বাগে আনা যায় না তখন এই শোধন চিকিৎসা (পঞ্চকর্ম চিকিৎসায়) এক ব্রহ্মাস্ত্র।
শোধনযোগ্য রোগ ও রোগী
মেদবহুল রোগী, অনিদ্রা বা অতি নিদ্রাতুর রোগী, দুর্বলরোগী, পাণ্ডু রোগী, বিবিধ ত্বকজ বিকার, উৎসাহহীনতায় ভুক্তভুগী রোগী সর্বোপরি রোগের মূলোৎপাটনের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা বিকল্পহীন।bs