প্রসবের সময় অনেক মা এক সাথে দুই বা তার অধিক সন্তানের জন্ম দেন। যমজ শিশু গর্ভে ধারণ করার বিষয়টিকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ‘মাল্টিপল প্রেগনেন্সি’ বা একের অধিক শিশুকে গর্ভে ধারণ করা বলা হয়। এক গবেষণা অনুযায়ী, সম্প্রতি যমজ শিশুর জন্মহার আগের তুলনায় বেড়েছে। যমজ সন্তান কেন হয় তা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। টুইন বেবি জন্ম নেওয়ার বিষয়টি পরিবারের সবার জন্য আনন্দের হলেও হবু মা কে এ সময় বেশ কিছু জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আজকের ফিচারে জানাবো টুইন প্রেগনেন্সি কেন হয়, এর প্রকারভেদ ও জটিলতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
টুইন প্রেগনেন্সি কেন হয়?
সাধারণত টুইন প্রেগনেন্সি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে টুইন প্রেগনেন্সির হার বেড়ে যেতে পারে। যেমন- বয়স বাড়ার সাথে সাথে হরমোনাল কারণে একের অধিক পরিপূর্ণ ডিম্বানু ওভারি থেকে রিলিজ হতে পারে, সেক্ষেত্রে দুটি শুক্রাণু দ্বারা দুটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়। বর্তমানে বন্ধ্যাত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় এর চিকিৎসাও সহজলভ্য হয়েছে। এদেরকে Assisted Reproductive Technology বলে, যেমন- আইভিএফ (IVF)। এই পদ্ধতিতে একের অধিক ভ্রুণ মাতৃগর্ভে রোপণ করা হয়। তাই এইসব চিকিৎসার ফলে যে সব মায়েরা গর্ভবতী হন, তাদের গর্ভে একের অধিক সন্তান আসার সম্ভাবনা স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার চেয়ে বেশি। এছাড়াও মায়ের বংশে যদি যমজ সন্তান হওয়ার ইতিহাস থাকে, তবে যমজ জন্মদানের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
টুইন প্রেগনেন্সি কেন হয়
টুইন প্রেগনেন্সি কত ধরনের হয়?
সাধারণত দুই ধরনের টুইন প্রেগনেন্সি হয়। যেমন- ফ্র্যাটারনাল টুইন (Fraternal Twin) এবং আইডেন্টিক্যাল টুইন (Identical Twin)। চলুন জেনে নেই এ বিষয়ে বিস্তারিত-
ফ্র্যাটারনাল বা ডাইজাইগোটিক টুইন
এই ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় থেকে দুটি ডিম্বানু বের হয় এবং দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্পার্ম দ্বারা নিষিক্ত হয়। এর ফলে যে টুইন হয় তারা একই অথবা ভিন্ন সেক্স উভয় রকমই হতে পারে। এদের পৃথক পৃথক প্ল্যাসেন্টা এবং এমনিওটিক স্যাক (ভ্রুণের ধারক থলি) থাকে। যার ফলে দেখা যায় যমজ হলেও এদের লিঙ্গ, রক্তের গ্রুপ, গড়ন, গায়ের রঙ বা অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্য এক নয়। তবে দুজন একই রকম হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
আইডেন্টিক্যাল বা মনোজাইগোটিক টুইন
এরা একটি মাত্র জাইগোট থেকে বড় হতে পারে। অর্থাৎ একটি পরিপূর্ণ ডিম্বানু একটি মাত্র শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে একটি জাইগোট গঠন করে এবং দুটি পৃথক কোষে বিভক্ত হয়। পরবর্তীতে প্রতিটি পৃথক কোষ থেকে দুটি ভ্রুণ সৃষ্টি হয়। আবার কখনো এদের নিজেদের আলাদা আলাদা প্ল্যাসেন্টা ও এমনিওটিক ফ্লুইড স্যাক থাকতে পারে। এরা দেখতে হুবহু একই রকম হয়। যেহেতু শিশু দুটি পুরোপুরি একই জিন (Gene) বহন করে এবং সকল বৈশিষ্ট্য একই রকম হয়, তাই এদেরকে অনেক সময় আইডেন্টিক্যাল টুইন বলে। এরা সাধারণত একই লিঙ্গের হয়ে থাকে অর্থাৎ দুটি ছেলে বা দুটি মেয়ে হতে পারে।
টুইন প্রেগনেন্সির প্রকারভেদ
কী কী জটিলতা হতে পারে?
মাতৃগর্ভে দুটো বা তার বেশি শিশু থাকলে গর্ভবতী মা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। জটিলতাগুলো হচ্ছে-
টুইন টুইন ট্রান্সফিউশন সিনড্রোম
টুইন প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে এই জটিলতাটি দেখা দিতে পারে। ১৫% আইডেন্টিক্যাল টুইনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে টুইনদ্বয় একই প্ল্যাসেন্টা শেয়ার করে, যার ফলে রক্তনালিকাও একই থাকে। একই রক্তনালিকা হওয়ায় যে কোনো একটি ভ্রুণ অপরটি থেকে বেশি রক্ত ও পুষ্টি সরবরাহ পায়। ফলে অপর ভ্রূণটি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে সেই ভ্রুণটির বৃদ্ধি কমে যায় এবং এমনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণও কম হয়। এতে গর্ভকালীন অনেক রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়, এমনকি দুর্বল ভ্রূণটির মৃত্যুও হতে পারে।
এছাড়াও আরও যে জটিলতাগুলো দেখা দেয় তার মধ্যে রয়েছে-
প্রিম্যাচিউর বার্থ বা সময়ের আগেই শিশুর জন্মগ্রহণ
মিসক্যারেজের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া
জন্মগত ত্রুটির সম্ভাবনা বৃদ্ধি
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ
রক্তস্বল্পতা
সিজার ও প্রসব পরবর্তী জটিলতা বৃদ্ধি
গর্ভে থাকা অবস্থায় একটি বাচ্চা বেঁচে থাকলেও আরেকটি মারা যাওয়ার মতো গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে
সাবধানতা
১) যমজ শিশু নিয়ে গর্ভধারণ করলে গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান জন্ম দেয়ার সময় তার ঝুঁকি সাধারণ গর্ভাবস্থার তুলনায় অনেক বেশি থাকে। গর্ভে একটি বাড়তি শিশু মানেই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
২) স্বাভাবিক প্রেগনেন্সির তুলনায় গর্ভের সন্তান সুস্থ রয়েছে কিনা, অন্যান্য বিষয় ঠিকঠাক আছে কিনা জানতে নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ
৩) যদি কোনো মা জানতে পারেন যে, তার গর্ভে যমজ শিশু রয়েছে তাহলে তাকে অবশ্যই বিশ্রামে থাকতে হবে।
৪) গর্ভে একটি বাড়তি শিশু মানেই বাড়তি পুষ্টির চাহিদা। এ ব্যাপারে হবু মায়ের যত্নে পরিবারের সকলকেই সচেতন হতে হবে।
যমজ সন্তান হওয়া স্বাভাবিক একটি ঘটনা হলেও যমজ সন্তান ধারণ করলে গর্ভবতী মায়ের নানাবিধ সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এজন্য এ সকল ক্ষেত্রে শুরু থেকেই একজন স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থাকলে মা ও শিশু দুজনেরই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।