বেশিরভাগ সময়েই মেয়েরা তাদের শারীরিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে যায় বা কারো সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে ইতস্তত বোধ করে। একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন প্রতিটা মেয়েকেই পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এটা অতি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা! তেমনি সাদাস্রাব বা হোয়াইট ডিসচার্জও মেয়েদের জন্য একটি সর্বজনীন বিষয়। প্রতিটা মেয়েরই জানা উচিত যে মাসের কোন সময়ে কেমন ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ থাকতে পারে, এটার স্বাভাবিক রঙ কেমন হয় ও কোন সময়ে তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। চলুন, আজ আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেই!
ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ নিয়ে যত কথা
ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ কী?
যোনিপথ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে যেই স্রাবটা বের হয়, সেটাই ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ! ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ মেয়েদের প্রজনন পদ্ধতিকে পুনরুৎপাদনশীল করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফ্লুইড বা মিউকাস বের হয়ে ভ্যাজাইনার মৃত কোষ, অনিষিক্ত ডিম্বাণু ও ব্যাকটেরিয়া বের করে দেয় এবং ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। ডিসচার্জের মাধ্যমে মেয়েদের রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম বা প্রজননতন্ত্র পরিষ্কার ও সচল থাকে। ভ্যাজাইনায় অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যার পরিমাণ হরমোন ও এসিডের মাত্রা দ্বারা নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হয়।
ডিসচার্জ বেশি হওয়ার কারণ
বয়সভেদে মাসিকচক্র অনুযায়ী মেয়েদের ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জের পরিমাণ, রং ও টেক্সচার বা ঘনত্ব আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আঠালো, সাদা ও স্বচ্ছ স্রাব যেতে পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশেষ কিছু সময় ছাড়া অতিরিক্ত ডিসচার্জ অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যহীনতার কারণ হতে পারে। স্রাব বেশি হওয়ার কারণগুলো একনজরে দেখে নিন তাহলে-
১) জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ গ্রহণ
২) শরীরে হরমোন ও পি এইচ ব্যালেন্সের তারতম্য
৩) অপুষ্টি ও জল ঠিকমতো না খাওয়া
৪) গর্ভাবস্থা ও ডায়াবেটিস
মাসিকচক্রে ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ এর রং ও ধরন
প্রত্যেকটি মেয়েরই তার স্রাবের রং ও গন্ধ স্বাভাবিক আছে কি না সেটা নিজে নিজে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সময়ভেদে ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জের ঘনত্ব বিভিন্ন রকম হতে পারে। এই ডিসচার্জের যেকোনো অস্বাভাবিকতা আপনার অসুস্থতার ইঙ্গিত হতে পারে। মেন্সট্রুয়াল সাইকেলে কোন সময়ে কেমন স্রাব যাওয়া স্বাভাবিক, সেটা প্রত্যেকটি সচেতন নারীর জানা প্রয়োজন। চলুন এবার তা জানার চেষ্টা করি-
১) দিন ১-৫
মাসিকচক্রের ১-৫ দিন সাধারণত লাল রঙের ব্লাড যায়, যেটা পিরিয়ডের রক্ত! ঋতুস্রাব হচ্ছে অনিষিক্ত ডিম্বাণু, মিউকাস, ইউটেরাইন টিস্যুর মৃত কোষ ইত্যাদির সংমিশ্রণ। অনেকের ৭ দিন পর্যন্ত পিরিয়ড থাকতে পারে।
২) দিন ৬-১৪
মাসিক শেষ হবার পরপরই ভ্যাজাইনা শুষ্ক অনুভূত হয়। এ সময়ে ওভারিতে ডিম্বাণু তৈরি ও ম্যাচিউর হওয়া শুরু করে। অনেকের ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণে ঘন, সাদা কিংবা হলদেটে স্রাব যেতে পারে।
৩) দিন ১৪-২৫
এই ফেজকে উর্বর সময় বা fertile window বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ এই সময়ে ডিম্বাণু নিষ্কাশন হয়ে ফেলোপিয়ান টিউবে আসে। তাই এই সময়ে শারীরিক মিলনে সন্তান গর্ভে আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ওভাল্যুশনের সময় ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বেশি হতে পারে এবং ডিমের সাদা অংশের মতো পাতলা, পিচ্ছিল ও স্বচ্ছ স্রাব হয়ে থাকে। ওভাল্যুশনের পর যোনি পথ আবার শুষ্ক ফিল হয় কিংবা সামান্য আঠালো ও ঘন স্রাব থাকতে পারে।
৪) দিন ২৫-২৮
পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগের সময়টা সাধারণত ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ থাকে না বললেই চলে! এই সময়ে মেয়েদের প্রজননতন্ত্র পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর ডিম্বাণু যদি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে যায়, সেটা জরায়ুতে স্থাপিত হয়। আর সেই সময় হালকা গোলাপি বা বাদামি রঙের ডিসচার্জ যেতে পারে। এটাকে ইমপ্ল্যানটেশন ব্লিডিং (implantation bleeding) বলা হয়।
কোন সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত?
স্রাবের কোনো অস্বাভাবিক রঙ ও ধরন খেয়াল করলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ জরায়ুর ইনফেকশন, ক্যানসার এসব রোগের লক্ষণও প্রকাশ পায় ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জের মাধ্যমে। তাহলে জেনে নিন কিছু অস্বাভাবিক ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ সম্পর্কে।
১) হলুদ স্রাব অস্বাভাবিক, এটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বা যৌনবাহিত সংক্রমণের একটি চিহ্ন। সাধারণত দুর্গন্ধও পাওয়া যায় এই ধরনের ডিসচার্জে।
২) বাদামী রঙের স্রাব যাদের অনিয়মিত মাসিক চক্র থাকে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এটি অনেক সময় জরায়ুমুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হয়ে থাকে।
৩) সবুজ স্রাব জীবাণু সংক্রমণের লক্ষণ। যৌনবাহিত ইনফেকশন থাকলেও অনেক সময় সবুজাভ ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ যেতে পারে।
৪) ধূসর রঙের স্রাব অস্বাস্থ্যকর এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত একটি উপসর্গ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে যোনীপথে আরও উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন- অস্বস্তি, চুলকানি ইত্যাদি।
৫) ইস্ট বা ছত্রাক সংক্রমণে পুরু, ঘন এবং সাদা স্রাব নির্গত হয়। মোটামুটিভাবে ৯০ শতাংশ মহিলারা তাদের জীবনের কোন না কোন সময়ে ছত্রাক সংক্রমণের সম্মুখীন হয়।
তাহলে জেনে নিলেন, মাসিকচক্র অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ সম্পর্কে! অস্বাভাবিক রঙের স্রাব ছাড়াও মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্ত যাওয়া, সময়মতো পিরিয়ড না হওয়া, অতিরিক্ত দুর্গন্ধ এসব কারণেও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। যোনিপথের যেকোনো সমস্যা কিংবা ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জের অস্বাভাবিকতা থাকলে অবশ্যই একজন সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা নেয়া উচিত। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।