রক্ত দেওয়া–নেওয়ার আগে যে বিষয়গুলো জানা জরুরি, জেনেনিন কিছু জরুরি তথ্য

আমাদের শরীরের সামান্য রক্তে একজন রোগীর অনেক উপকার হয়। অনেক মানুষ এই সামান্য সাহায্যে নতুনভাবে বাঁচার রসদ পান। তাই রক্তদান যে কোনও মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। কাউকে রক্ত দেওয়ার অর্থ হল, তাকে নতুন জীবন দান করা। কিন্তু এর পাশাপাশি রক্ত দিলে নিজের শরীরেও অনেক উপকার হয়। বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

রক্তদান করে কী লাভ? : রক্তদানে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি কমে,ক্ষতিকর চর্বির পরিমাণ কমে ইত্যাদি নানা উদ্বুদ্ধমূলক কথা সমাজে প্রচলিত। এর সবগুলোই আপেক্ষিক। এমনও দেখা গিয়েছে, নিয়মিত রক্ত দিচ্ছেন কিন্তু একসময় গিয়ে দেখলেন উচ্চরক্তচাপ দেখা গিয়েছে। এই কারণে ট্রান্স ফিউশন মেডিসিনের বইতে লেখা আছে the chief benefit lies in the satisfaction of selfless concern for the welfare of others.এই লাইনের মাঝে লুকিয়ে আছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার আসল সাফল্য। অর্থাৎ, নিজের লাভের জন্য নয় আরেকজনের উপকার করার মাঝেই তৃপ্তি।

রক্তদাতার শ্রেণিবিন্যাস করলে আমরা দেখি-
১) পার্টি ডোনার: রক্তদাতা যখন জানেন উনি কাকে রক্ত দিচ্ছেন। আমাদের দেশে এদের সংখ্যাই বেশি। ২) স্বেচ্ছায় রক্তাদাতা: রক্তদাতা যখন জানেন না উনি কাকে রক্তদান করছেন। এদের শতকরা হার যতদিন বাড়বে না আমরা কখনই ঘাটতি পূরন করতে পারবো না। ৩) প্রফেশনাল ডোনার: একসময় এদের সংখ্যাই বেশি ছিল। নানা কর্মসূচির কারণে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে কমে এসেছে। ৪) দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ডোনার: সঠিক জানা নেই এই বিধান এখনও বলবৎ আছে কিনা যেখানে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা রক্তদান করলে মওকুফের সুযোগ থাকতো। রক্তের কোনও বিকল্প এখনও বের হয়নি বলে যখন রক্তের প্রয়োজন হয় তখন যেভাবেই হোক তা পূরণ করতে হয়।

ছেলে মাকে রক্ত দিলেই সমস্যা হচ্ছে : প্রফেশনাল ডোনারের সংখ্যা কমানোর চেষ্টায় একসময় প্রচলিত ছিল রক্ত নিকটবর্তী আত্মীয় থেকে নেওয়ার জন্য। কিন্তু একসময় দেখা গেলো এতে ভবিষ্যত আরও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে।

ছেলে মাকে রক্ত দিয়েছিল একসময়, পরবর্তীতে মায়ের শরীরে সেই রক্তের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। তাই ছেলে মাকে রক্ত দিলেই সমস্যা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, ছেলের কাছে মা কোনও অঙ্গ গ্রহণ করতে পারছে না।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, জাপানে প্রতি ৭০ হাজারে একটি ব্লাড রিজেকশান হয়। কারণ তাদের জেনেটিক্যাল সিমিলারিটি খুবই বেশি। আমরা সেই রকম না বলে অনেক ভাগ্যবান। এই কারণে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার বিকল্প নেই।

রক্ত যখন দেয়া যায় না : আর চাইলে সবাই রক্ত দিতে পারেন না। নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে তার জন্য।দেশ সরকার আইন করে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এবরশন হলে ৬ মাস, রক্ত পরিসঞ্চালন করলে ৬-১২ মাস, সার্জারি ৬-১২ মাস, টাইফয়েড হলে রোগমুক্তির পর ১২ মাস পর্যন্ত রক্ত দেয়া যায় না।

এছাড়া ম্যালেরিয়া জ্বর হলে ৩ মাস (এনডেমিক) ও ৩ বছর( নন এনডেমিক), ট্যাটু মার্ক করলে ৬ মাস, ব্রেস্ট ফিডিং করলে সন্তান জন্মের পর ৬ -১২ মাস, দাঁত উঠালে ২ সপ্তাহ, চর্মরোগ (একজিমা) হলে আরোগ্য লাভ পর্যন্ত,গর্ভাবস্থায় সন্তান প্রসবের পর ৬ মাস, লোকাল ইনফেকশান হলে সেরে উঠা পর্যন্ত রক্ত নেয়া হয় না।

নারীদের ঋতুস্রাব বা মাসিক চললে সেরে উঠা পর্যন্ত, সাধারণ সর্দি জ্বর হলে সেরে উঠা পর্যন্ত, রেবিস ভেক্সিনেশান পর ১ বছর, ইবিউলিগ্লোবিউলিন ইঞ্জেকশান দিলে ১ বছর, ইমুইনাজেশান(কলেরা, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, প্লেগ) করলে ১৫ দিন, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুয়া হলে ৬ মাস সময়ে রক্ত দিতে পারেন না।

এসব জেনে নিয়েই রক্তদাতা থেকে রক্ত গ্রহনের কার্যক্রম শুরু করতে হয়। Hb না দেখে(গড়পরতা ১২) কোনও অবস্থাতেই রক্ত নেওয়া উচিত নয়, তাতে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। রক্ত দানের পর যে ঘাটতি হয়ে তা পুরন হতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা সময় লাগে(ভলিউম পূরণ হতে) আর সেলের ঘাটতি পূরণ হতে ৩-৮ সপ্তাহ সময় লাগে।
এই কারনে রক্তদানের পর ১-২ সপ্তাহ Hb করে ভয়ের কোনও কারন থাকে না।

রক্তদান করলে শরীরে আয়রনের যে ঘাটতি হয় তা পুরুষের ক্ষেত্রে ৩ মাসের মাঝে এবং মহিলাদের দেড় বছর সময় (যেহেতু মাসিকের মাঝেও লস হয়) লাগে। এই কারনে পুরুষেরা বছরে ৩ বার এবং মহিলারা বছরে ২ বারের বেশি রক্তদান করা উচিত নয়।

যারা নিয়মিত রক্ত দান করেন তাদের অবশ্যই আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করা উচিত না হলে একসময় বিপদের আশংকা রয়েছে।

রক্তদান করার পর রক্তদাতার প্রতি পরামর্শ

১) আধা ঘণ্টার মাঝে ধূমপান করবেন না। ২) পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা স্বাভাবিকের চেয়ে জল বেশি খাবেন। ৩) স্বাভাবিক কাজ করবেন ৪) পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালনা থেকে বিরত থাকবেন ৫) স্বাভাবিক খাবার খাবেন ৬) মাথা ভারী লাগলে,ঝিমঝিম করলে বসে পড়ে মাথা দু পায়ের মাঝে দিয়ে নিচু হয়ে থাকবেন কিছুক্ষণ, তাতেও ভালো না লাগলে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করবেন। ৭) রক্তদানের পর হাত ভাঁজ করে না রেখে স্বাভাবিক রাখবেন (এতে রক্তের স্বাভাবিক চলাচলের মাধ্যমেই রক্তপাতের সম্ভাবনা কমে যায়)। ৬ মাসের মাঝে হেপাটাইটিস দেখা দিলে যেখানে রক্ত দিয়েছেন সেখানে জানানোর ব্যবস্থা করবেন (কারণ সেই গ্রহীতারও হয়তো চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে)।

স্বেচ্ছায় রক্তদাতাই রক্তের সত্যিকার উৎস। শ্রীলঙ্কার মত দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার শতকরা ৯০ ভাগের উপরে সেখানে আমাদের দেশে ৩০ ভাগের মধ্যেই এখনও পড়ে রয়েছি। আজ বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে আসুন আমরা নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদান করে ভবিষ্যতকে ঝুঁকিমুক্ত করতে শপথ নিই।

Related Posts

© 2024 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy